হরিপদ ভৌমিক :
পঞ্জিকার জ্যৈষ্ঠ মাসের পাতাটি খুললে জামাই খেতে বসেছে, সামনে থালায় সাজানো নানারকম খাবার, একজন নারী তাল পাতার পাখা হাতে নিয়ে হাওয়া দিচ্ছে। আর দরজায় দাঁড়িয়ে রয়ছে আরও কয়েকজন মহিলা— তারা উৎসুক হয়ে কিছু দেখছে। কি দেখছে? একালের মানুষ তা বুঝতে পারবেন না। কারণ, বহুদিন হল একান্নবর্তী সংসার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, এখন সংসার বলতে স্বামী-স্ত্রী এবং একটি কন্যা বা পুত্র সন্তান। তাই ‘শালি’ শব্দটির এখন আর তেমন মাধুর্য নেই, এখন শালি বলতে ‘তুতো শালি’ অর্থাৎ খুড়তুতো, জেঠতুতো, পিসতুতো, মামাতুতো বা পাড়াতুতো।
পঞ্জিকা পাতার দরজায় দাঁড়ানো নারীরা আসলে শালির দল। জামাই ঠকাবার জন্য যা করে রেখেছিল তা দেখতে দরজায় ভিড়। সেকালের কলকাতার ‘জামাইষষ্ঠী’-তে কেমন অনুষ্ঠান হত তার একটি সুন্দর বর্ণনা ছাপা হয়েছিল ১৮৫১ সালের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায়— লেখক দীনবন্ধু মিত্র। শুরু করেছিলেন নতুন জামাইদের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি দিয়ে।
নতুন জামাইবাবাজীবন প্রথমে মিহিসুতোয় বোনা বিখ্যাত ‘ঢাকাই ধুতি’ পড়লেন। কাঁধে নিলেন চাদর বা ‘উড়ানি’, এই উড়ানি কিন্তু যেমন তেমন নয়। তখনকার দিনে বিখ্যাত ‘সবুজ বরণে বারানসী উড়ানি’। কবি বলেছেন, এ উড়ানি আসলে ‘নায়িকার নয়ন-জুড়ানি’। কেউ কেউ আবার ‘গলায় রুমাল বেঁধে বাড়ায় মাধুরী’।
ধুতি-চাদর বলা হয়ে গেল, বাদ রয়েছে জামা। আর কোনওটির পরিচয় ‘কামিজ’, কোনওটির ‘পীরণ’ আবার কোনওটির নাম ‘পেংগি’। এই দামি জামাগুলিতে তখন একটি করে ঘড়ি-পকেট থাকত। ঘড়ি পকেট থাকলে কি হবে— সে যে পকেটে আছে তার জানান দিত ‘ঘড়ির-শিকল’— যা জামার বুকে বোতামের সঙ্গে যুক্ত থাকত। জামাইয়ের পকেটে রইল পকেট ঘড়ি। মাথাটা আঁচড়ে ‘বিলাতী-সিঁতি’ কেটে নিতেন। অনেকে আবার বিলেতি ধরনের ‘বাকা-সিঁতি’-ও কাটতেন। নতুন জামাই মুখ সজ্জায় ‘কালনাগিনী পেড়ে ধুতি’-টির ‘কোঁচার শেষের ফুল’-টি হাতে নিয়ে দুগগা দুগগা বলে বেরিয়ে পড়তেন। ও গয়নাগাটির কথা তো আবার বলা হয়নি। জামাইয়ের ‘গলায় বিলাতি চেন’ আর ‘কোমরে সোনার বিছা’, এবং ‘করগাথা’ অর্থাৎ আঙ্গুলগুলি ‘সুশোভি করিল অঙ্গুরী’-তে। হাতে থাকত ‘হেম-ছড়ি’।
শ্বশুরবাড়িকে তখন ‘মধুপুর বলা হত’, কারণ নতুন জামাইদের জন্য বিশেষ বিশেষ আয়োজন থাকত সেখানে, সেই আদরের নামই ‘জমাই-আদর’। মধুপুরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু, তখন যেতে পালকি, ঘোড়ার গাড়ি না হয় ‘চরণ-বাহন’ অর্থাৎ হেঁটে যাওয়া। হেঁটে যাওয়াটা তখন কিন্তু অপমানের ছিল না।
মধুপুরে এসে সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সদর ঘরে শ্বশুরমশাইকে প্রণাম করাটা হল প্রথম কাজ। জামাই এসেছে— খবর পৌঁছে গেল অন্দরমহলে। প্রেমানন্দে শালিরা সব পুলোকিত হয়ে প্রস্তুত হয়ে গেল! জামাইবাবাজীবনকে শ্বশুরমশাই পাঠিয়ে দিলেন অন্দরে— কবি যাকে ‘আনন্দ-ভবন’ বলেছেন। নতুন জামাই এসেছে, জামাই-বরণ, আশীর্বাদ করা প্রভৃতি লৌকিক ক্রিয়াকে কবি বলেছেন, ‘মেয়ের ভেরুয়া করা শাশুড়ির ক্রিয়া’। অর্থাৎ জামাই মেয়ের মনের মতো হোক, মেয়ে যা বলবে জামাই যেন তা মেনে চলে।
লোকাচার পর্ব শেষ হলে শাশুড়ির কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে জামাইবাবাজি গিয়ে পড়লেন শালিদের হাতে, এবার তিনি ‘জামাইবাবু’। শুরু হত শালিদের জামাইবরণ, কাঠের পিঁড়ির নীচে চারদিকে চারটি সুপারি দিয়ে পিঁড়ির ওপরে আসন পেতে জামাইবাবুকে বসতে দেওয়া হল। আহ্লাদে আটখানা হয়ে পিঁড়িতে বসতেই পিঁড়িটি টলে চলতে শুরু করল। ঘাবড়ে গেল জামাইবাবু— শালিরা হইহই করে বলে উঠল—‘ঘোড়া ছাড়া গাড়ি যায় দেখ দেখ বলে’। হাসির ছটা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল।
সেকালে জামাই-ঠকানো যে-জিনিসপত্র মেয়েরা তৈরি করত তা নাকি আসলকে হার মানাতো। এই দেখুননা! ‘কলাগাছ-গোড়া কেটে ভাল ডাব করে’ আর ‘বিচুলির জলে করে মিছরির পানা’। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরম তাই ‘তৃষ্ণায় জামাই খাবে, না করিবে মানা’। বাটিতে করে যে ‘চিনি দিয়েছে’, সেটিও নকল—‘নুনের করেছে চিনি দেখিতে সুন্দর’। নকল করার কাজে সেকালের মেয়েরা কতটা গুণী ছিল তা বোঝাতে কবি বলেছেন—এই নকল চিনি ‘পিপীলিকা খায় ভুলে’। প্রত্যেকটি জিনিস ছিল নিখুঁত, মেয়েরা কাঁঠালের বিচি কেটে করেছে কসুর’। আজকাল স্যালাড করে শসা দিতে, জামাইয়ের পাতে নকল-শসা কীভাবে তৈরি করেছে শুনুন— ‘অপরূপ শসা করে ত্যালাকুচা কেটে’। সেকালের জামাইয়ের পাতে ঘরে ক্ষীর করে, ছাঁচ তুলে মিষ্টি বানিয়ে দেওয়া হত। নকল মিষ্টি করেছে—‘তেঁতুলের বিচি কেটে করে ক্ষীর-ছাঁচ’। আর ‘পিটুলির চন্দ্রপুলি গুড়া চূণ নুন’।
আমি তো সেকালের চতুরা মেয়েদের চাতুরির দু’চারটি উদাহরণ দিলাম। নকল খাবার সাজিয়ে দিয়ে মেয়েরা জামাইকে খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করেছে, কবির ভাষায় ‘মাথা খাও মাথা খাও, বলে বামাগণে’। জামাইবাবুটির তখন কী হাল হত আপনারাই বুঝে দেখুন। তার ‘পেটে খিদে, মুখে লাজ’— চাপে পড়ে ‘হেট মুখে আদপেটা খায়’।
শ্বশুরবাড়িতে জামাইষষ্ঠীতে জামাইকে নিয়ে শালিরা যে রঙ্গ-রসে মাতিয়ে রাখত সেদিন হারিয়ে গেছে বহুকাল আগে। জামাই-ঠকানো খাবার সাজিয়ে রাখা পাতে কীভাবে জামাইবাবু খাবেন, খেয়ে তার প্রতিক্রিয়া কী তা দেখতে দরজায় ভিড় করা কৌতূহলী নারীদের, এবং জামাইয়ের পাশে বসে হাওয়া বড় শালির ছবিটি যা আজও পাঁজির পাতায় জামাইষষ্ঠীর ছবিতে দেখা যায়—তা হল জামাই ঠকানোর পুরনো স্মৃতি! যা সততই সুখের।
Check Also
চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক
ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …
আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ
জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …
নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই
সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …