চিন্ময় সিংহরায় :
যে-কোনও বড় কাজের ইনিশিয়েটিভ নেওয়া হয়, যেমন কিছুদিন আগে হইচই হয়ে গেল ডিমনিটাইজেশন নিয়ে বা আজ থেকে ১০-১৫ বছর আছে যখন ভ্যাট, টাক্স চালু করা হয় তখনও ঠিক এইভাবেই হইচই হয়েছিল। সবই ভাল। উদ্দেশ্য কোনওটারই খারাপ নয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে অর্থনীতি বা সমাজব্যবস্থাটা যেরকম তাতে করে এটা প্রয়োগ করা সঠিক নয়। কারণ, জিএসটি বা ভ্যাট কোনওটাই আমাদের দেশের কথা ভেবে তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে বা এগুলো সাফল্য পেয়েছে পৃথিবীর তথাকথিত উন্নত দেশগুলোয়। অন্যদেশের নিয়ম-শৃঙ্খলা এনে আমাদের দেশে ‘কপি-পেস্ট’ করা হচ্ছে। ইউএস বা ইওরোপে সমাজব্যবস্থা চালানো হয় যথেষ্ঠ সুসংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে। সেখানে আমাদের দেশে সেটা হয় না। এখানে দু’দিন আগে ঠিক করে মাঝরাতে চালু করে দেওয়া হল জিএসটি। এটার কী প্রয়োজন ছিল! এই ট্যাক্সটি চালু করতে গেলে গোড়ার যে পরিকাঠামো সেই ব্যাপারটা কী ঠিকঠাক হয়েছে আজ অবধি! উওরটা হচ্ছে ‘না’। জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া সবক’টা রাজ্যে জিএসটি বিলটা খাতায় কলমে পাশ হয়ে গেছে। প্রথমদিকে লোকসভাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এই বিল পাশে সমস্যা হলেও, অনেক কাণ্ড করে পিছনের দরজা দিয়ে তা পাশ হয়ে যায়, তারপর রাজ্যসভাতে এল। খাতায়-কলমে পাশ হলেও, বেসিক পরিকাঠামোটা কোথায়?
জিএসটির জন্যে সারা দেশ জুড়ে জিএসটিএন(নেটওয়ার্ক) নামে একটি সফটওয়্যার আছে। সেটার মাধ্যমে ট্যাক্স জমা করতে হবে। অর্থাৎ ঘুরিয়ে বলতে গেলে প্রতিটি ব্যবসায়ী, সে ফুটপাতের লোকই হোক আর চায়ের দোকানই হোক কিংবা মাল্টিস্টোরেড দোকানই হোক, প্রত্যেকেই ওই বিশেষ সফটওয়্যারটায় অ্যাক্সেস রেখে তার সঙ্গে নিজের পরিকাঠামোটাকে সামঞ্জস্য রেখে কানেক্টেড থাকতে হবে। এবং তার মাধ্যমে ট্যাক্স জমা করতে হবে। এবার রাস্তার ধারের যে চায়ের দোকাটা, নিয়ম অনুযায়ী তাঁরও সার্ভিস ট্যাক্স জমা করার কথা। কিন্তু সে কী পারবে এটা করতে? আমাদের মতো দেশে সেটা কোনওদিন সম্ভব! এই জায়গাটাতেই উঠছে প্রশ্ন। আমি পরিকাঠামোটাকে একটা ঠিক সময়ের মধ্যে নিয়ম করে তৈরি করলাম, সবাইকে সেই পরিকাঠামোর উপযোগী করে তুললাম, তারপর আমি একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করলাম। তাহলে ভাল, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। ঠিক যেমন ডিমনিটাইজেশনের সময় হঠাৎ সন্ধে বেলায় ঠিক করলেন কয়েকঘণ্টার মধ্যে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল হবে, আসছে নতুন নোট। সেইসময় কোনও কোনও ছোট ব্যবসায়ীর পকেটে তাঁর সারা বছরের সঞ্চয় ছিল, তাঁদের ব্যাঙ্কিং-এর পরিষেবাটুকু নেওয়ারও ক্ষমতা নেই। তাহলে এবার তাঁরা কোথায় যাবে। এর বিকল্পটা কী!
এমনকী সিঙ্গুরের কারখানা, উদ্দেশ্য কী খারাপ ছিল! ‘না’! শিল্পায়ন হোক রাজ্যে বড় শিল্প আসুক। কিন্তু বাস্তবে কী দাঁড়ালো! এমন একটা জায়গা বাছা হল যেখানে দোফসলি জমিতেই কারখানা হবে এটার কী যৌক্তিকতা! যা সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে ব্যাঙ্কের নয় হাজার কোটি টাকা বিজয় মাল্য নিয়ে চম্পট দেয় সেখানে সাধারণ মানুষ নিয়ম মেনে ইনকাম ট্যাক্স ভরছে। একই দলের পরিচালিত রাজ্যগুলোয় হাজার হাজার টাকার কৃষি ঋণ মুকুব হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই রাজ্যের নাগরিকের বাচ্চার স্কুল ফিজটা বেড়ে গেল এই জিএসটি কারণে। এর সঙ্গে এখনও এই বিষয়টাও পরিষ্কার নয়, কোন কোন জিনিসের দাম বাড়বে আর কোন কোন জিনিসের দাম কমবে। আমি একজন সাধারণ সরকারী কর্মচারী, আমার কর ফাঁকি দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই, আর আমি দিচ্ছিও না, আমি নিয়ম মেনেই সব করছি। ঠিক আমার পাশের বাড়ির কোনও এক কৃষকের কৃষি ঋণটা মুকুব হয়ে গেল। যার ফলে অনাদায়ী হিসেবে ব্যাঙ্কে ঢুকল ঋণের বোঝা। এবার ব্যাঙ্ক এটা আমার আপনার ঘাড়ে চাপাচ্ছে। কেন? যার প্রধান কারণ আমাদের দেশের পরিকাঠামো একদমই ঠিক নয়। ইউএস-এ তে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সবদিকেই একটা নির্দিষ্ট কাঠামো মেনেই কাজ হয়। মোদীর নিজের রাজ্যের এই জিএসটির প্রতিবাদ হচ্ছে। কলকাতার বড়বাজারে হইচই হচ্ছে এর প্রতিবাদে। এই বিক্ষোভগুলো করছে বেশিরভাগই ছোট ব্যবসায়ীরা। কারণ, তাঁদের ওপর আঘাতটা সব চেয়ে বেশি। পরিকাঠামোর জায়গাটাতেই তাঁরা নেই। বড় যে, সে সাধারণত নিয়ম মেনে চলে, বা না চললে বিজয় মাল্যর মতো হয়। সুতরাং আমি যদি দেখি আমি নিয়ম মানছি আর বাকিরা নয় তাহলে তো সত্যিই সমস্যার। স্বাধীনতার ৭০ বছর হয়ে গেল এটাই হয়ে আসছে। সলমন খান থেকে অভিনেতা বিক্রম চট্টোপাধ্যায় বা কালীকাপ্রসাদের ড্রাইভারের কথাই বলুন, প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। পরিকাঠামো এমন, যাঁর অর্থবল, ক্ষমতা আছে সে ঠিক ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। আইন আইনের জায়গায় থাকবে কিন্তু প্রয়োগের জায়গায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এখানেই প্রশ্ন চিহ্ন। আমরা কী তৈরি!
লাইক, শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন