গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় :
শিরোনামটা কী হওয়া উচিত? মোদী ম্যাজিক না জাদুকর মোদী? নাকি মোদী দ্য ইলিউশ্যনিস্ট? রাজনীতি থেকে সাংবাদিক, সকলকে থ করে আস্তিন থেকে টেনে বার করেছেন বিজেপি মনোনীত রাষ্ট্রপতির নাম। কে? না, বিহারের রাজ্যপাল রামনাথ কোবিন্দ। তিনি কে ছিলেন, কোথা থেকে এলেন, কেমন করে এলেন, এসব বিষয়ে আপাতত কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কারণ, সংবাদপত্র থেকে টিভি থেকে ওয়েবপোর্টাল— সর্বত্র এখন তাঁর ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে ঝুড়িঝুড়ি তথ্য। তিনি এ লেখার আলোচ্য বিষয় নন। তাঁকে নিয়ে কোনও প্রশ্নও নয়।
আচমকা বিহারের দলিত রাজ্যপালকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী মনোনয়ন করে মোদী যে ম্যজিক দেখালেন, তাতে বিরোধী এবং সাংবাদিককুল যে অতিশয় বিস্মিত এবং চমৎকৃত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এইভাবে দিনের পর দিন ম্যাজিক দেখিয়েই মোদী প্রথমদিন থেকে ভারতবাসীকে নন্দনকানন দর্শন করিয়ে চলেছেন। এবার দলিত রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন করে তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাতে (অদূরেই যেখানে নির্বাচন) দলিত আন্দোলনের ধার তিনি ভোঁতা করে দিতে চান। হয়তো রোহিত ভেমুলার মা নিজেও এরপর মনস্তাপে ভুগবেন, কেন তিনি এইরকম এক মহানুভব প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। কিন্তু ভারতের তামাম দলিতের কী হবে? সে প্রশ্নের উত্তরে মোদী নিশ্চয় আবার অন্য একটি ইন্দ্রজালের ব্যবস্থা করবেন। দরিদ্র ভারতবাসীর আশা, এভাবেই মোদীর ম্যাজিক দেখেই তাঁরা পেট ভরাতে পারবেন।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বললেন, মামেকং শরণং ব্রজ। তাঁকে শরণ করলেই হবে, তিনি সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি দিয়ে মোক্ষলাভ করাবেন। মোদীও প্রথমদিন থেকে একই কথা বলে চলেছেন, তাঁর চরণাশ্রিত হলেই সব হবে। তিনি আস্তিন থেকে একটির-পর-একটি তাস বের করে চলেছেন। কিন্তু ভারতবাসীর মোক্ষলাভটাই শুধু যা হচ্ছে না। মোদী বললেন, নোটবাতিল করবেন। আগের রাত্রি পর্যন্ত কেউ সে কথা জানতে পারলেন না, এমনকী নিজের খোদ অর্থমন্ত্রীও না। এই হল মোদীর ‘চমৎকার’। নোট বাতিলের কারণটা কী? কেন! কালো টাকা উদ্ধার। দেশের আপামর লোক জয়ধ্বনি দিয়ে বলল, হ্যাঁ, এসেছেন বটে একখান প্রধানমন্ত্রী। একেই বলে ছাপান্ন ইঞ্চি বুকের পাটা। দিনরাত এক করে, গ্রাম থেকে শহর তখন একটাই প্রশ্ন— এটিএম-এ টাকা পেলেন? রোদ্দুর মাথায় করে, মুখে একরাশ তৃপ্তির হাসি নিয়ে ভারতবাসী দেখাল, তারা এখনও ‘হও উন্নত শির’ বলে লাইনে দাঁড়াতে জানে। লাইনে গন্ডাখানেক মানুষ প্রাণ দিয়ে দেখালেন শুধু আহার নিদ্রা ত্যাগ নয়, দেশের প্রয়োজনে দেশবাসী প্রাণত্যাগেও পিছপা নয়। কিন্তু মোদীজি যে কালো টাকা উদ্ধারের কথা বলেছিলেন, তার কী হল? সিকি, আধুলিও তো তালুতে এসে পড়ল না। ভারতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নামক যে সংস্থা আছে, সে-ও আজ পর্যন্ত জানাতে পারল না কী পরিমাণ কালো টাকা উদ্ধার হয়েছে। যদি সত্যিই তা উদ্ধার হত, তাহলে কি আর মহারাষ্ট্র আর মধ্যপ্রদেশের কৃষকদের মাঠে নামতে হত? ইয়েট ব্রুটাস ইজ অ্যান অনারেবল ম্যান। আমরা বড়ই স্থিতধী, প্রবচনের গূঢ়ার্থ না ভেবে, নীরব হয়ে সরল প্রাণে তোমায় ডাকি।
মোদী বললেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ হচ্ছে। আমরা সরল প্রাণে সে কথাটাই বিশ্বাস করলাম, মোদী তো ম্যাজিক জানেন। ইওরোপ খাবি খাচ্ছে, দেশের আর্থিক হাল ফেরাতে নাজেহাল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন টলোমলো, গ্রিস তো আগেই গিয়েছে, ট্রাম্প সাহেব রোজ ধমক দেন, আগে আমেরিকানদের চাকরি দাও, পরে অন্য কথা, দেশের টাকা যেন আর হুটহাট বাইরে না যায়। তবু প্রবাসী প্রধানমন্ত্রী মাঝে মাঝে দেশে ফিরেই জানান দেন, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেশে লগ্নি হয়ে চলেছে। আমরা তো মোদী দ্য ম্যাজিশিয়ানকেই বিশ্বাস করি, অতএব, নিশ্চয় সেরকম কিছু-একটা হচ্ছে বা হয়ে চলেছে, আমরা জানতেও পারছি না। মহারাজের পোশাকে সামনে মোদী আর পিছনে ঐন্দ্রজালিক ধুম্রজাল। সেখানে কী চলছে তা জানা আমাদের মতো সাধারণ জনতার কর্ম নয়। মোদী বলছেন, আর দেরি নয়, ধর গো তোরা। আমরাও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হাতে হাত ধরে প্রস্তুত।
যে-পাকিস্তানের নিজেরই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, যে দেশে সেনা-স্কুলের মধ্যে বোমা ফাটিয়ে কচি, ফুলের মতো শিশুদের মেরে ফেলে সন্ত্রাসবাদীরা, যে-দেশে মসজিদের মধ্যে আত্মঘাতী বোমা মেরে সুফি সাধকদের জীবননাশ করে জঙ্গিরা, যে-দেশ একদিকে মসজিদ অন্যদিকে সেনার হাতে বন্দি, সে দেশের বিরুদ্ধে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে মোদী হাসি হাসি মুখে ক্যামেরার দিকে হাত নাড়েন। আপামর জনসাধারণের মুখের হাসির বাঁধ ভাঙে। কিন্তু মুখের হাসি বন্ধ হতে-না-হতেই জঙ্গি হানা আর দাঙায় দেশ পর্যুদস্ত হয়ে যায়। কাশ্মীরে এমনই শান্তি ফিরে আসে যে, ধেয়ে আসা পাথরের হাত থেকে বাঁচতে কাশ্মীরি যুবক ফারুক আহমেদ ডরকে গাড়ির বনেটে বেঁধে অকুস্থল থেকে বেরোতে হয় সেনা বাহিনীকে। আর মানবাধিকারের মুখ বন্ধ করে সেনাদের উজ্জীবিত রাখতে বিতর্কিত সেনা অফিসার মেজর গগৈকে পুরস্কার দিতে হয়। মোদীর ম্যাজিকে আমরা এখনও মোহিত, আমরা এখনও উদ্দীপ্ত।
আমরা জানি, তিনি হঠাৎ কোনও একদিন আস্তিনের তলা থেকে এমন রঙের টেক্কা বার করবেন যা দেখে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাবে, আমরা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকব তাঁর দিকে। সেদিন হয়তো ‘সব কা বিকাশ’ ক্যাপশন সাঁটানো ছবিতে অনুপম খের, নানা পাটেকর, পরেশ রাওয়ালের পিছনে খান কয়েক শাহরুখ্-আমির খানের মুখ খুঁজে পাওয়া যাবে, আলু, পটলের দাম নিয়ে চিন্তা থাকবে না, দেশে বিনিয়োগের বন্যা বয়ে যাবে, কৃষক, দলিতরা ধন্যি ধন্যি করবে, জঙ্গিরা সব গোল হয়ে বসে ‘যত মত তত পথ’ উচ্চারণ করতে থাকবে।
আর হ্যাঁ, এ সবের ফাঁকে মোদী হয়তো আবার একটি নতুন তাস সংসদের টেবিলে ফেলবেন। বাজেটে শাসক দলের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ‘কাউ ট্যাক্সে’র ঘোষণা হবে।
হয়তো মোদির ম্যাজিকে সবই হবে। আপাতত তো মোদির ম্যাজিকের দৌলতে দেশটা বিজেপির দখলে যাক, তারপর তো সব।