সূর্য সরকার:
“থাপ্পড় মেরে গাল লাল করে দেব। কিভাবে কথা বলতে হয় শেখোনি !” শুনেই কিছুটা হতচকিত প্রশান্ত কিশোরের টিমের এক সদস্য। ফোনের ওপারে উত্তর কলকাতার এক বরিষ্ঠ তৃণমূল বিধায়ক। কিন্তু কেন ? ঘনিষ্ঠ মহলে সেই রগচটা বিধায়ক অভিযোগ করেছেন, “কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা এরা শেখেনি। বলা-কওয়া নেই ফোন করে নির্দেশ দিচ্ছে। সবকিছু বলার একটা ধরণ থাকে।” তৃণমূল সূত্রের খবর, শুধু ‘থাপ্পড় মারবো’ বলেই থেমে থাকেননি ওই বিধায়ক। উল্টে রাগের মাথায় বলেছেন, “গিয়ে তোমাদের অফিস ভেঙে দিয়ে আসবো। করব না কর্মসূচি। তোমাদের যা ক্ষমতা থাকে করো” কিছুটা হতভম্ব হয়ে ফোন কেটে হাঁফ ছাড়েন টিম পিকের জনৈক সদস্য!
প্রসঙ্গত, ভোটগুরু প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি নিয়ে সারা রাজ্যজুড়ে তিন দফায় চলছে তৃণমূলের জনসংযোগের প্রয়াস। কিন্তু, এই কর্মসূচি নিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসন্তুষ্ট তৃণমূল বিধায়ক মন্ত্রীদের একটা বড় অংশ। অভিযোগ, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মহিলা বিধায়করা পড়ছেন নানাবিধ সমস্যায়। রাতে গ্রামের বাড়িতে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তাঁরা, তাছাড়া শৌচালয়ের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাঁদের। কেউ কেউ এখনও পথে নামনি, কেউবা ‘দিদিকে বলো’ সেরেছেন নমোনমো করে! ফাঁকি দিলে, ঘাড়ে চেপেছে পিকে স্যারের বাড়তি টাস্কের বোঝা।
তবে, কর্মসূচি পালনে কোনও অসুবিধা নেই তৃণমূল বিধায়কদের। কিছু সমস্যা হলেও সামলে নিচ্ছেন তাঁরা। তাল কাটছে অন্য জায়গায়। টিম প্রশান্ত কিশোরের ব্যবহারে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে একাধিক বিধায়কদের মধ্যে। অভিযোগ, ফোন করে কার্যত ‘নির্দেশে’র সুরে কথা বলছে পিকে টিম। প্রশ্ন উঠেছে, দলের নির্দেশ আসবে দলীয় স্তর থেকে, সেটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু, কোনও বিধায়ককে কোনও তথ্য বা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন সঠিক আচরণ করবে না প্রশান্ত কিশোরের বাহিনী? সব থেকে বড় গোল বেঁধেছে খাস কলকাতার এই বরিষ্ঠ বিধায়কের ক্ষেত্রে। কোথাও কোথাও কথাবার্তা, বাচনভঙ্গির ক্ষেত্রে প্রশান্ত কিশোরের টিমের একটা অংশের ‘দোষ’ রয়েছে, ঘনিষ্ঠ আলোচনায় স্বীকার করছেন তৃণমূল বিধায়কদের অনেকেই। আবার, অনেকে ভালো ব্যবহারও পেয়েছেন। দুর্গাপুর-আসানসোলের এক বিধায়কের কথায়, “আমার সঙ্গে সেরকম কোনও সমস্যা হয়নি। ভালো করেই কথা বলেছে। যা যা করতে হবে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে।” এক সুর উত্তরের এক চল্লিশোর্ধ বিধায়কের গলায়। তবে, দক্ষিণের এক মহিলা বিধায়কের গলায় আবার উল্টো সুর। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “দল নির্দেশ দেবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা বাচ্চা ছেলে ফোন করে বলছে, করতেই হবে, যেতেই হবে, এমন করে কথা বলছে যেন আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। কথাবার্তা একটু ভালো করে বললেই হয়।” তবে, ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি তিনি করেছেন বলেও জানালেন মহিলা বিধায়ক।
যদিও, তৃণমূলের এক বরিষ্ঠ মন্ত্রীর কথায়, “এরম হওয়ার কথা নয়। কারণ, যেদিন প্রশান্ত কিশোর আমাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, সেই বৈঠকেই তিনি বলেছিলেন আমাদের পরামর্শ দেওয়া তাঁর কাজ। এবং তাঁর টিমের লোকজনের ওপরেও আমাদের সঙ্গে সেইরকম বুঝেশুনে কথা বলার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রশান্ত।” যদি, এরকম খারাপ ব্যবহার কিছু হয়ে থাকে তাহলে সেটা ‘বিক্ষিপ্ত’ বলেই মনে করেন সেই মন্ত্রী। কিন্তু কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে অন্য সমস্যার পড়ছেন গ্রামাঞ্চলের মহিলা বিধায়করা। অনেক মহিলা বিধায়কের কপালে জুটছে তস্য পাড়াগাঁ। পশ্চিম মেদিনীপুরের এক মহিলা বিধায়কের অভিজ্ঞতা, “রাত কাটাতে কর্মীর বাড়িতে গিয়েছি। একজন একজন করে গ্রামের লোকেরা অভাব অভিযোগ জানাচ্ছেন। কে টাকা নিয়েছে , তাই নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই হঠাৎ আমার সামনেই দু’পক্ষ হাতাহাতি শুরু করে দিল। আমি পড়লাম ফাঁপরে। তার মধ্যে নেই কোনও নিরাপত্তারক্ষী। শেষপর্যন্ত পুলিশ ডেকে ঝামেলা সামলানো গেল। রাত ১টার পর ঝামেলা মিটল। এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছিলেন সেই বিধায়ক।
এমন অভিজ্ঞতা অনেকের । “দিদিকে বলো’ পালন করতে গিয়ে আবার গ্রামের বাড়িতে থেকে ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বরও বাঁধিয়েছেন এক মহিলা বিধায়ক। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গ্রামের বাড়িতে শৌচালয়ের সমস্যার জন্য আবার ‘প্রকৃতির ডাকে’ সাড়া না দিয়ে সারা রাত কষ্ট করে থাকছেন মহিলা বিধায়করা।