শৈবাল মিত্র :
আজ ৭৬ বছর হল নেতাজি ভারত ছেড়ে গিয়েছেন আর ৭২ বছর হল তাঁর মৃত্যু নিয়ে রহস্য শুরু হয়েছে। কিন্তু এই বাহাত্তর বছরে নেতাজি যে কতবার মরলেন আর বাঁচলেন তা বোধহয় গুনে শেষ করা যাবে না। জীবদ্দশায় তাঁকে যে-পরিমাণ শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে তা বোধহয় তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কাউকেই করতে হয়নি। মানুষটি স্বভাবে ছিলেন আবেগপ্রবণ। দেশপ্রীতিকে তিনি আধ্যাত্মিক অনুভবের স্তরে নিয়ে গেছিলেন। তাঁর চরিত্রে আধ্যাত্মিক ও আবেগ প্রবণতার কথা সকলেরই জানা। তা নাহলে তিনি ভারতের জুসেপ্পে গ্যারিবল্ডি হতে পারতেন না।
১৯৪৫ সালে নেতাজি যখন অন্তর্হিত হলেন তখন তাঁর বয়স ছিল আটচল্লিশ বছর। উধাও হয়ে যেতে তিনি বিশেষ দক্ষ ছিলেন। ১৯৪১ সালে কলকাতা শহর থেকে তিনি যে উধাও হয়েছিলেন তা কিন্তু অনেকটাই বাধ্য হয়ে। তৎকালীন ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে কোণঠাসা করা হয়েছিল এতাটাই যে, দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক লড়াই করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। নেতাজির সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, তার অনেকটাই কেটেছিল প্রবাসে। দেশের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় অবশ্যই ছিলেন। সেই সঙ্গে প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যেও তাঁর জনপ্রিয়তা
খুব-একটা কম ছিল না। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি তাঁর কাছে অজানা ছিল না। ফলে, দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি যখন কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন ও কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী অংশের নেতা হয়ে উঠলেন তখন তাঁকে দেশীয় রাজনীতিতে ঠাঁই দেওয়া রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধীর নেতৃত্বকে উলটে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন সুভাষচন্দ্র বসু। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের অসারতাকে তিনি জনসমক্ষে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন।
এই প্রেক্ষপটকে মনে না রাখলে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্যকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। আমরা জানি নেতাজি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যেই দেশ ছেড়েছিলেন। তিনি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের চোখে ধুলো দিয়ে ভারত ত্যাগ করেছিলেন বলেই আমরা জানি। পরবর্তী কালের নেতাজি গবেষকরা কিন্তু জানতে পেরেছেন যে, নেতাজির ভারত ত্যাগের গোটা পথের হাল হকিকত অজানা ছিল না ব্রিটিশের কাছে। তারা যেহেতু চেয়েই ছিল যে সুভাষ বোস ভারতের রাজনৈতিক আঙিনা থেকে সরে যান, তাই তাঁকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। তারা হয়তো ভেবেছিল প্রবাসে গিয়ে সুভাষ বসুর রাজনৈতিক জীবনের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু তা হয়নি। তিনি কংগ্রেসে প্রথম সারির একজন নেতার স্তর থেকে আন্তর্জাতিক এক নেতার স্তরে উন্নীত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর অক্ষশক্তির সঙ্গে হাত মেলানোর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। তা নিয়ে যত বিতর্কই থাক না কেন, এ কথা মানতেই হবে অক্ষশক্তিই ছিল তাঁর কাছে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র ভরসার স্থল। আবার এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে ‘নেতাজির শেষ অবধি কী হল’ তা আজও জানতে না পারার কারণ বা তার মৃত্যুরহস্যের আসল চাবিকাঠি।
দ্বিতীয় বিশযুদ্ধে যদি অক্ষশক্তির জয় হত তবে হয়তো এমনটা হত না। মনে রাখা দরকার পরাজিত অক্ষশক্তির প্রধান সেনাপতি যাঁরা ছিলেন, যেমন হিটলার, মুসোলিনি, তোজো প্রমুখ এঁদেরই সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুভাষ বসু স্বাধীন ভারতের প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে। পরাধীন ভারতের সরকার কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই মিত্রশক্তির অংশ ছিল। ফলে, যুদ্ধ শেষে পরাজিত প্রবাসী ভারত সরকারের রাষ্ট্রপতির ভাগ্যে জার্মান, ইতালি বা জাপানের রাষ্ট্রপতিদের থেকে আলাদা কিছু হওয়ার কথা ছিল না, হয়ওনি। হিটলার, মুসোলিনি বা তোজোর পরিণতি আমরা জানি। জানি না শুধু স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি সুভাষ চন্দ্র বসুর শেষ পরিণতি।
সত্যি বলতে কি কোনও দিনও হয়তো এর উত্তর আমরা পাব না। কত মানুষ তো নিরুদ্দেশ হন। সবার খোঁজ কি আর পায় তাঁর পরিবারের লোকেরা? নেতাজির ক্ষেত্রেও আমরা তথ্যপ্রমাণসহ কোনও দিনও জানতে পারব না ১৯৪৫ সালের পর তাঁর জীবন কোন খাতে বয়েছিল। কিন্তু তবু যাকে বলে circumstantial evidence বা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ তার ওপর ভিত্তি করে একটা উত্তর খুঁজে নেওয়া যা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
নেতাজি গবেষকদের একটি বড় অংশ সেই কাজে অনেকটাই এগিয়েছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী নেতাজির বাকি জীবনের একটা আবছাছবি ফুটে ওঠে যা অনেকেরই মেনে নিতে অসুবিধে হলেও ওই পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে। তা হল, ১৮ অগস্ট ১৯৪৫ সালে তাইহোকুতে নেতাজির মৃত্যু হয়নি। বিচারপতি মুখার্জি তা তথ্যপ্রমাণসহ বলে দিয়েছে। এবার সেটা ভারত সরকার যদি না মেনে নেন তবে কারওর কিছু করার না থাকলেও সত্যটা থেকেই যায়। তিনি তাইহোকুর দিকে যানইনি। তার রাশিয়া যাত্রাকে আড়াল করতে ওই দুর্ঘটনার গল্প ফাঁদা হয়েছিল। নেতাজি নিরাপদেই রাশিয়ায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে অন্তত স্তালিনের মৃত্যু পর্যন্ত রাশিয়ায় থেকে আরও একবার ভারত আক্রমণের চেষ্টা করছিলেন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে। অতএব নেতাজি যে কেবল ফ্যাসিবাদের দিকে ঝুঁকে ছিলেন তা নয়, তিনি সাম্যবাদীদের দিকেও ঝুঁকে ছিলেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল যে-করে হোক ভারতকে সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্ত করার। কিন্তু ক্রমশ তিনি লক্ষ করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিপুল পট পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে তাঁরই চোখের সামনে। শুরু হচ্ছে Cold War বা ঠান্ডা লড়াইয়ের কাল। সেই পালা বদলের কালে তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট দেশগুলির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধে একজন কুশীলবের ভুমিকায় অবতীর্ণ হন নেপথ্য নায়ক হিসেবে। চিনে তাঁর উপস্থিতির উল্লেখ পাওয়া গেছে। এমনকী ভিয়েতনামেও তাঁর যাতায়াত থাকতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। ১৯৫৫ সালের পর সুভাষ বসু ভারত সরকারের জ্ঞাতসারেই দেশে ফিরে আসেন এই শর্তে যে তিনি কখনওই নিজের পরিচয় প্রকাশ করবেন না। ১৯৮৫ সালে কোনও সময় ৮৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
কিন্তু নেতাজির বাকি জীবনের এই ভাষ্য যতক্ষণ-না সরকারি মান্যতা পাবে ততদিন এই ভাষ্য নিয়ে বিতর্ক চলবে। যতই তাঁর ভক্তরা নেতাজির মৃত্যুরহস্যের জট খুলতে চেষ্টা করুন না কেন কেবল ভারত সরকারের ফাইল ঘেঁটে সব উত্তর পাওয়া যাবে না। তার জন্য দরকার রাশিয়াসহ আরও অনেক দেশের সরকারি ফাইল ওলটানোর। নেতাজিকে আমরা প্রাথমিকভাবে আমাদের দেশের এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জানলেও তিনি যে একজন আন্তর্জাতিক স্তরের নেতা হয়ে উঠেছিলেন তাঁর এই পরিচয়টিকে সব সময় মনে রাখি না। আর তাই সেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির টানাপোড়েন ও বাধ্যবাধকতা এমনই যে, নেতাজি মৃত্যুরহস্যের কারণগুলোকে ক্রমশ ফসিলের আকার দিয়ে দিচ্ছে। হয়তো আরও একশো বছর বা তারও পর কোনও এক গবেষকের চেষ্টায় হা্রিয়ে যাওয়া বা লুকিয়ে রাখা অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণের নথিটি সকলের সামনে আসবে। ততদিন নেতাজি সুভাষ বসুকে নিয়ে এ দেশে জাতীয় রাজনীতির খেলা যেমন চলছে তেমনি চলবে।
এটা হতেই পারে যে ১৯৪৫ সালে যুদ্ধে পরাজিত রাষ্ট্রনায়ক সুভাষ চন্দ্র বসু হয়তো নিজেই নিজের মৃত্যুর কাহিনী রচনা করেছিলেন। গবেষকদের নথি বলছে যে তিনি নিজেকে তারপর থেকে Dead Man বলে সম্বোধন করতেন। থাকতেন অত্যন্ত দীনহীন অবস্থায়। চোখের সামনে তিনি তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন ভারতবর্ষকে দু টুকরো হয়ে যেতে দেখেছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিষে গান্ধিজিকে খুন হতে দেখেছেন। একটা গোটা জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়কে প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু নীরব থেকেছেন তাঁর অজ্ঞাতবাসে বসে। কারণ নিজেকে তিনি Dead Man বলে মেনেই নিয়েছিলেন। তাই সুভাষ বসু ১৯৪৫ সালে মারা গেছিলেন নাকি তারপর মারা গেছিলেন কিনা তা আজ আর প্রয়োজনীয় নয়। একজন মহান দুঃসাহসী অথচ ট্র্যাজিক এক রাষ্ট্রনায়ক তাঁর প্রতীকী স্বেচ্ছামৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে ছিলেন। আধ্যাত্মিক মনন তাঁকে নিয়ে গেছিল বাঁচামরার অনেক উর্ধ্বে। তাই তাঁর অর্ধেক জীবন নিয়েই তিনি তাঁর দেশবাসীর কাছে অমর। সরকারি ফাইল কি বলছে বা বলবে তাতে কিছুই যাবে আসবে না।