Breaking News
Home / TRENDING / বিসমিল্লার পাগলা সানাই

বিসমিল্লার পাগলা সানাই

পার্থসারথি পাণ্ডা

বেনারসের পঞ্চগঙ্গা ঘাট। পেশোয়াদের বংশের কেউ বালাজী বিষ্ণুর মন্দির গড়ে তুলেছিলেন এই ঘাটে। তাই এই ঘাট ‘বালাজী ঘাট’ নামেও পরিচিত। ওস্তাদ বিসমিল্লাহ্‌ খাঁ সাহেব এই ঘাটে এসে রোজ রেওয়াজ করতেন, চরাচরে ছড়িয়ে দিতেন তাঁর সানাই-সুরের মায়াজাল।

কাকভোর থেকেই গঙ্গায় ডুবকি দিয়ে মন্দিরে ঢুকে একের পর এক ভক্ত বালাজীর পুজো করে আশীর্বাদ নিতেন, তখন খাঁ সাহেব এসে শুধু মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে হাত রাখতেন, ঠিক ভেতরে যেখানটায় বালাজী দাঁড়িয়ে, সেখানটায়। মনে মনে স্তোত্র পাঠ করে পুজো করতেন তাঁকে, পায়ে দিতেন সুরের অর্ঘ্য। এই ভক্তের ডাকে ভগবান সাড়া না-দিয়ে পারেননি। অনেকদিন অনেকবার এই ঘাটে সুরসাধনায় মগ্ন খাঁ সাহেব পেয়েছিলেন বালাজীর দিব্যদর্শন। পণ্ডিত ভীমসেন যোশীজী একবার এক ইন্টারভিউতে জানিয়েছিলেন যে, গুরুদেবের আশ্রমে তুঙ্গভদ্রার তীরে সুরসাধনার সময় তাঁরও এমন দিব্যদর্শন হত। সঙ্গীতসাধকের কাছে আসলে সুরই ঈশ্বর, ঈশ্বরই সুর। খাঁ সাহেব বলতেন, আল্লাহ একা, সুরও একা। দুজনকেই সাধনায় পেতে হয়, আত্মার সঙ্গে আত্মা জুড়ে এক হতে হয়। সুর সাধনার পথে তাই সুর ও ঈশ্বর দুজনেরই দেখা পেয়েছিলেন, কৃপা পেয়েছিলেন এই সাধকেরা। জাতপাত-ধর্ম-সম্প্রদায় সব কিছুর উপরে সুরই ঈশ্বর, সুরই আল্লাহ্‌। সুরের ধারায় ঈশ্বর-আল্লাহ দুজনেই আসলে এক। তাই, অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে মন্দির হবে, না মসজিদ, এই নিয়ে গোটা দেশের যখন চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে; তখন খাঁ সাহেব অনায়াসেই বলতে পেরেছিলেন, মন্দিরও না, মসজিদও না, ওখানে একটা মঞ্চ বানিয়ে দাও, যেখানে আমি সানাই বাজাব, পণ্ডিত রবিশংকর বাজাবেন সেতার।

বিহারের ডুমরাও গ্রামে মার্চের ২১ তারিখে, ১৯১৬ সালে জন্ম হয়েছিল খাঁ সাহেবের। মা মিঠান বেগম ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। কোরআনের শুরুতে বিসমিল্লাহ্‌, কোরআন জুড়ে বিসমিল্লাহ্‌। তাই তিনি ছেলের নামও দিলেন বিসমিল্লাহ্‌। বাবা পয়গম্বর খাঁ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ওস্তাদ ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরাও তাই ছিলেন। সুতরাং, বিসমিল্লাহ্‌ খাঁ সাহেবের রক্তেই ছিল সঙ্গীত। তার ওপর মাত্র সাত বছর বয়সে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শহর বেনারসে এলেন মামা আলী বকসের সঙ্গে। খাঁ সাহেবের ঠাকুরদার আমল থেকেই লোকবাদ্যযন্ত্র সানাইতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বাজিয়ে একটা নতুন কিছু করার চেষ্টা চলছিল। মামা আলী বকস সেই ঐতিহ্যেরই উত্তরাধিকারী। বিশ্বনাথ মন্দিরে ইনি সানাই বাজাতেন। সাত বছরের ভাগ্নেকে ইনিই প্রথম কিনে দিলেন ছোট্ট একটি সানাই। এই ধরণের ছোট সানাইকে বলা হয়, ‘নফিরি’। এই সানাই দিয়েই চলতে লাগল খাঁ সাহেবের তালিম, সেইসঙ্গে মামা তাঁকে শেখাতে লাগলেন শাস্ত্রীয় কণ্ঠসঙ্গীত। ইনিই খাঁ সাহেবের গুরু, খাঁ সাহেবের ওস্তাদ। মূলত এঁদের প্রচেষ্টাতেই বিয়ে বাড়ির অঙ্গন থেকে সানাই নিজের জায়গা করে নিল রাগসঙ্গীতের দরবারে।

খাঁ সাহেব তখনও বালক। মামার সঙ্গে একটি সঙ্গীতের আসরে জুড়িদার হয়ে সানাই বাজাতে গেছেন। মামা একটি গৎ বাজানোর পর, খাঁ সাহেব শুরু করলেন রাগের আলাপ। সুরের মায়াজালে মুগ্ধ হয়ে গেল সবাই, আশ্চর্য হয়ে গেল, অল্প বয়সী একটি ছেলের রাগসঙ্গীতে অসাধারণ দখল দেখে। সেই অনন্য যুগলবন্দীর পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন রূপোর পদক। সেই শুরু। মামা বললেন, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যখন শুরু করেছ, আর থেম না। খাঁ সাহেব থামেননি। জগত জয় করে হয়ে উঠেছিলেন সানাই ও বিসমিল্লাহ্‌, বাদ্য-বাদক সমার্থক। সানাই অনেকেই বাজান, কিন্তু বিসমিল্লাহ্‌ ছাড়া কান তৃপ্ত হয় না। অন্তর তৃপ্ত হয় না। পুজোয় নিবেদিত নৈবেদ্য প্রসাদ হলে চেটেপুটে না-খেয়ে যেমন তৃপ্তি হয় না, এও যেন ঠিক তেমনি। কবীর সুমন একটি গানে তাই ওস্তাদ বিসমিল্লাহ্‌ খাঁ সাহেবকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খাই/ বিসমিল্লার পাগলা সানাই’।

বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

https://www.youtube.com/channelhindustan

https://www.facebook.com/channelhindustan

Spread the love

Check Also

চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক

ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …

আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ

জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …

নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই

সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *