স্বপনকুমার ঠাকুর :
কখন মরণ আসে কেবা জানে কালীদহে কখন যে ঝড় কমলের নাল ভাঙে; ছিঁড়ে ফেলে গাঙচিল শালিকের প্রাণ জানি নাকো;
— জীবনানন্দ দাশ
সত্যি! কার কখন যে মৃত্যু হবে—অপ্রত্যাশিত বিপদ আসবে অতর্কিতে—তা কেউ জানে না। অথচ মানুষের জীবনে আঘাত বিপদআপদ এসেই থাকে। এর সঙ্গে মোকাবিলা করে চলার নামই তো জীবন যুদ্ধ। হিন্দুধর্মের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দৈববিশ্বাস। মনে করা হয়, বেশকিছু বিপদআপদ দুর্জ্ঞেয় রহস্যময় দৈবশক্তি প্রভাবিত। আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় বিশেষভাবে বিপদতারিণীদেবীর শরণ নিলে। নিষ্ঠা ভরে বিপদতারিণী ব্রত পালন করলে বিপদআপদ দুর্ঘটনা আধিব্যাধি অর্থাৎ ভবযন্ত্রণা থকে রেহাই মেলে।
আষাঢ় মাসের জগন্নাথের রথ আর উল্টোরথের মাঝামাঝি মঙ্গল ও শনিবার বিপদতারিণী ব্রত করেন আপামর ভক্তিমতী হিন্দু রমণীগণ। কেউ কেউ আজীবন এই ব্রত পালন করেন। গ্রাম শহরে প্রাচীন দেবালয়ে বিপদতারিণী দেবীর উদ্দেশে পুজো হয়। কোথাও-বা দেবীর মূর্তি গড়ে শাস্ত্রসম্মত পুজো হয়। দেবী বাঘ্র বা সিংহবাহনা। চতুর্ভুজা বা দশভুজা। চতুর্ভুজা দেবীর নীচের বাম হাতে ত্রিশূল ও ওপরের হাতে খড়্গ। ওপরের ডান হাতে অভয় মুদ্রা আর নীচের হাত বরদ মুদ্রায় প্রদর্শিত। দশভুজা মুর্তি হলে দেবী দুর্গার মতোই দশপ্রহরণধারিণী। দেবী বসন পরিহিতা। পুজো হয় কোথাও মঙ্গলচণ্ডীর ধ্যানে।
হিন্দু দেবদেবীকে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন যথা বৈদিক দেবদেবী, পৌরাণিক দেবদেবী, লৌকিক এবং ব্রতের দেবদেবী। ব্রতের আবার বেশির ভাগই দেবী এবং শুধুমাত্র মহিলামহল কতৃক পূজিত। এই পুজোয় তথাকথিত মন্ত্রের সংযোজন পরবর্তী কালের। যেমন চণ্ডী মনসা শীতলা লক্ষ্মী ইত্যাদি। গবেষকরা মনে করেন বিপদতারিণী মূলত ব্রতের দেবী। পরবর্তী কালে ইনি পৌরাণিক দেবীতে পরিণত হয়েছেন। এবং দেবী দুর্গা ও কালীর মিশ্ররূপে প্রকাশিত হয়েছেন।
অনেকেই আবার এই বিপদতারিণী দেবীর সঙ্গে পুরীর জগন্নাথের শক্তি বিমলাদেবীর ঘনিষ্ঠ সংযোগ লক্ষ করেছেন। মা বিমলা সতীপীঠের অধিশ্বরী। পীঠমালা অনুসারে এখানে দেবীর নাভিপদ্ম পতিত হয়েছিল। জগিন্নাথের উচ্ছিষ্ট ভোগেই দেবীর ভোগ। আলাদা করে ভোগ রান্না হয় না। এই ভোগই বিমলা মায়ের পুজোর পর মহাভোজে পরিণত হয়। এই নিয়ে প্রচলিত আছে এক মজার লোকগল্প। একবার দেবাদিদেব মহাদেব গিয়েছিল গোলকে বিষ্ণু দর্শনে। তখন তাঁর দুপুরের আহার সবে সমাপ্ত হয়েছে। মহাপ্রসাদ জ্ঞান করে একটু উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করে মহাদেবের আর আনন্দ ধরে না। এদিকে বিষ্ণু প্রসাদ বঞ্চিত অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী এই আনন্দের হেতু জেনে মহাক্রুদ্ধ হলেন। তিনি শ্রীবিষ্ণুকে নালিশ জানালেন। পালনকর্তা বিষ্ণু জানান— দেবী! কলিযুগে পুরুষোত্তম রূপে আমি যখন অবস্থান করব পুরীর নীলাচলে তখন আমার কাছে থেকে আমার উচ্ছিষ্ট প্রসাদই হবে তোমার মহাপ্রাসদ! তাই দেবী বিমলার প্রসাদ মানেই জগন্নাথের নিরামিষ ভোগ। কিন্তু জগন্নাথের বলরাম সুভদ্রা যখন রথযাত্রায় মাসির বাড়ি যান তখন মা বিমলার শনি ও মঙ্গলবার বিশেষ পুজো থেকেই নাকি বাংলায় বিপদতারিণী দেবীর পুজোর উদ্ভব হয়েছে।
তবে বিপদতারিণী যে প্রাচীন ব্রতের দেবী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ব্রত এমন এক ধরনের মেয়েলি আচার কৃত্যমূলক অনুষ্ঠান যা নির্দিষ্ট বার বা তিথিতে সম্পাদিত হয়। এগুলি প্রজনন শক্তি বা গুহ্য জাদুশক্তির পুজো। মহিলারা ব্রত করেন সাংসারিক সুখ সম্পদ বৃদ্ধি, সর্বপ্রকার বিপদআপদ থেকে মুক্তিলাভের জন্য। এর কোনও তথাকথিত মন্ত্র নেই, রয়েছে আচার কৃত্য। একটি পুর্ণাঙ্গ ব্রত অনুষ্ঠানে তিনটি দিক থাকে। ব্রতের আচার কৃত্যাদি উপকরণ, ব্রতের জন্য আলপনা ও ব্রতকথা নামক অসাধারণ লোকগল্প যা বিলীয়মান ইতিহাসের নানা উপাদানে ভরপুর। বিপদতারিণী ব্রত অনুষ্ঠানে এই সবক’টি উপাদান আজও লক্ষ করা যায়।
বিপদতারিণী জাদুমূলক ব্রত। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন—সংসার রঙ্গমঞ্চে কোনও এক অদৃশ্য জাদুকর প্রতিনিয়ত যেন তাঁর জাদু প্রদর্শন করে চলেছেন। আজ যে ধনী বড়লোক কাল সে পথের ভিখারি। এই সুস্থ মানুষ দেখলাম তো, পরক্ষণেই সে চিতার আগুনে পুড়ছে। যে ছিল সবার পিছনে সে আজ সবার ওপরে। এর বড়ো জাদু আর কী আছে? হিন্দুধর্ম এই জাদুকে স্বীকার করেছে। আর এই জাদুকেন্দ্রিক লোকায়ত বিশ্বাস এসেছে প্রাগার্য সংস্কৃতি থেকে যা মহিলারাই শুধু পালন করতেন। বিপদতারিণীব্রত করার পর নারী-পুরুষ সকলেই সেই জাদুসুত্র ধারণ করেন। এ এক লক্ষণরেখা মতো সুত্রবন্ধনী। মনে করা হয় সর্বপ্রকার বিপদ আপদ থেকে মুক্ত রাখবে বিপদতারিণী এই ধাগা বা কবচ।
বিপদতারিণী পুজোয় লাগে ঘট, সশীষ ডাব, গোটা ফলের নৈবেদ্য, তেরোগাছি লালসুতো, তেরোটি দূর্বা, পান-সুপারি গোটা ফল ও নতুন গামছা ইত্যাদি। এমনিতে ১৩ সংখ্যাটিকে বিশ্বের প্রায় সকল দেশই অশুভ মনে করে। হিন্দুধর্ম তার ব্যতিক্রম নয়। প্রাচীন মিশরীয়রা ১৩ সংখ্যাকে মৃত্যুর প্রতীক ভাবতেন। খ্রিস্ট ধর্মালম্বীরা কখনওই এক টেবিলে ১৩ জন বসে খান না। প্রাচীন কালে ১৩ মাসের অনেক দেশে চান্দ্রপঞ্জিকা ব্যবহৃত হত। পরে অশুভ জ্ঞান করে ১২ মাসের সৌরপঞ্জিকা চালু হয়। বিপদতারিণী ব্রতে এই কারণে সকল দ্রব্যই ১৩টি নেওয়া হয়। এইভাবে অশুভ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা। এর থেকে বোঝা যায় এই বিপদতারিণী ব্রত কত প্রাচীন ও ইতিহাসের তথ্যে ভরপুর।
দেবীর পুজোর আগের দিন নিরামিষ আহার করে ব্রতিণীরা ‘বার’ করেন। পুজোর দিন নিজেদের নাম গোত্র ধরে পুজো করান। পুজোর পর ব্রতকথা শোনেন ও জাদু ধাগা বাঁধেন। শহর কাটোয়ার গৌরাঙ্গপাড়ায় ঠাকুরগোষ্ঠীর নন্দগোপাল ঠাকুর আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাটির বিপদতারিণী মূর্তি গড়ে শুরু করেন। সেই পুজো আজও চলেছে। অধিকাংশ শহরবাসী দেবীমন্দিরে পুজো দিতে আসেন। পুজো চলে প্রায় সারাদিন। শেষে হোম-যজ্ঞ হয়। এই পুজোর একটি অন্যতম লোকায়ত দিক হল কথক ব্রাহ্মনগণ ব্রতকথা শোনান। ব্রতকথা শোনার পর ১৩টি জাদু গিট দিয়ে ব্রতিণীর বাহুতে ধাগা বেঁধে দেন। এর বিনিময়ে তাঁরা সামান্য দক্ষিণা পান।
বিপদতারিণী ব্রত গল্পটি যেন ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল। কোনও একসময়ে বিদর্ভ নগরীর এক প্রবল পরাক্রান্তশীল নরপতি ছিলেন। তাঁর পাটরানির সই ছিল মুচিদের মেয়ে। মুচিরা সেইসময় হিন্দুদের নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করত। একদিন রানি আর কৌতূহলী সামলাতে না পেরে বলল— সই তুমি যা রান্না করছো তা আমাকে একটু দিও। মুচির কন্যা সেই মাংস রাজবাড়িতে নিয়ে গেল একটা খুঞ্চিপোষ ঢাকা দিয়ে। এদিকে রাজার প্রহরী এই ঘটনা জানতে পেরে রাজাকে খবর দিল। উত্তেজিত রাজা শাণিত তরবারি নিয়ে এসে রানিকে বললেন এই পাত্র যদি কোনওরূপ নিষিদ্ধ মাংস থাকে তাহলে তোমাকে হত্যা করব…। খোলা হল পাত্র!
রানিমা ছিলেন দেবী বিপদতারিণী পূজারি। তিনি তখন কাতর কন্ঠে দেবীকে ডাকতে শুরু করলেন… রক্ষা কর মা বিপদতারিণী…।
পাত্র খোলা হল। কিন্তু একি! রাজা কি দেখলেন? পাত্রের মধ্যে সাজানো সদ্য ১৩টি ফুল। রানি সেই জাদুফুলেই দেবী বিপদতারিণী পুজো করলেন ভক্তি ভরে!
লাইক, শেয়ার ও মন্তব্য করুন