সুস্নাত চৌধুরী :
রাজ্যে সব স্কুলে ক্লাস ওয়ান থেকে টেন, বাংলা বাধ্যতামূলক করার রাস্তায় হাঁটল রাজ্য সরকার। এ জন্য প্রাথমিক ভাবে তাদের সাধুবাদ দিতে হবেই। অনেকে গেল গেল রব তুলছেন – দার্জিলিঙের নেপালি মেয়েটি তবে বাংলা পড়তে বাধ্য? পুরুলিয়ার কুরমালি ছেলেটিকে পড়তেই হবে বাংলা? হ্যাঁ, পড়তেই হবে। আইন পাশ হওয়ার পর, এ রাজ্যের স্বীকৃত বাসিন্দা হয়ে থাকতে হলে শিখতে হবেই। কিন্তু নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা করে নয়। কারণ, তিনটি ভাষা শেখানো হবে প্রথম শ্রেণি থেকেই, তার মধ্যে যে-কোনও একটি বাংলা হলেই চলবে। বাকি দু’টির মধ্যে তার মাতৃভাষা থাকুক-না; চাইলে প্রথম ভাষা হিসেবেই থাকুক!
প্রশ্ন জাগছে অন্য জায়গায়। এই সিদ্ধান্ত কাদের ওপর প্রভাব ফেলবে? রাজ্য বোর্ডের স্কুলে যারা পড়ে, বা সিবিএসই-আইসিএসই পড়ুয়া হলেও যাদের অন্যতম ভাষা বাংলা, এই সিদ্ধান্ত সরাসরি তাদের প্রভাবিত করবে না। যে-অভিভাবক তাঁর সন্তানকে বাঙালি না করে ‘বং’ করে তুলতে চান, এ রাজ্যে থেকেও বাংলা শেখাতে চায় না, তাঁদের বাধ্য করবে বাংলা ভাষার সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে। আর বাংলা শিখতে বাধ্য করবে ভিন্ন ভাষার মানুষ, যাঁরা এ-রাজ্যে পাকাপাকি ভাবে রয়ে গিয়েছেন, তাঁদের নতুন প্রজন্মকে। কিন্তু এর ফলে কি কাজের কাজ কিছু হবে? যে-বাঙালি চানই না তাঁর ছেলে বা মেয়েটি ঠিকঠাক বাংলা বলুক বা বাংলা বুঝুক, যথেষ্ট অপশন থাকা সত্ত্বেও যে বাংলা ভাষার ধারেকাছে শিশুটিকে ঘেঁষতে দেননি, স্কুলে বাধ্যত বাংলা পড়তে হলে সে কিছু-একটা বাংলা শিখবে ঠিকই, কিন্তু সেই ট্যাঁশ অভিভাবককুলের মানসিকতার অন্তত বিরাট বদল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। আর ভিনরাজ্যের বা ভিন্ন ভাষার মানুষ যদি বাংলা শেখে, তাতে বাঙালি আত্মশ্লাঘা বোধ করতেই পারে, কিন্তু দূর ভবিষ্যতে তাতে বরং লাভ হওয়ার সম্ভাবনা সেই ভিন্ন ভাষার পড়ুয়াটিরই। বাংলা ও বাঙালির প্রতি তার ‘জাত-বিদ্বেষ’ না থাকলে নতুন একটি ভাষা ও সাহিত্যের দরজা তার সামনে খুলে যাবে।
বাংলা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত শিক্ষাক্ষেত্রের হলেও, যে-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তা নেওয়া হল, তা ভেবে দেখার। ভাষাক্ষেত্রে হিন্দির আগ্রাসন বহুচর্চিত বিষয়। এ রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত কি রাজ্য সরকারের কাছে সেই আগ্রাসনের ধারণাকে আরও প্রকট করে তুলল? যে-সময়ে সিবিএসই দেশ জুড়ে বাধ্যতামূলক করছে হিন্দি, ঠিক তার পর পর রাজ্যের এই ঘোষণায় তেমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। যেন বিজেপির তথাকথিত জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাভাষী মানুষকে একজোট করার চেষ্টা। মাস্টারস্ট্রোক হয়তো, কিন্তু রাজনীতির প্রভাব শিক্ষাঙ্গনে এসে পড়লে তা অনেক রকম সমস্যাও তৈরি করতে থাকে। একটি কল্পিত উদহারণ দিই। ধরা যাক, দার্জিলিং-এ সিবিএসই বোর্ডের একটি নেপালি ছাত্র, এখন তিনটি ভাষার মধ্যে বাধ্যতামূলক ভাবেই তাকে হিন্দি ও বাংলা নিতে হবে। তৃতীয় ভাষাটি তাহলে সে কী নেবে? নিশ্চয়ই ইংরেজি। তার মানে, দু’টি চাপিয়ে দেওয়া ভাষার কারণে সে নিজের মাতৃভাষা পাঠের অধিকার হারাল!
আশা করব, এই ধরনের সমস্যাগুলোর কথা মাথায় রাখবে রাজ্য। কেন্দ্রও। তাদের টানাপোড়েন আর ভাষার রাজনীতি যেন কারওর মাতৃভাষার অধিকার না কেড়ে নেয়। ১৯৪১ সালে অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন। বইটির নাম ‘বাংলা পড়ানো’। তার উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল – ‘…শিক্ষাসংস্কারে সর্বদা উদ্যোগী ডক্টর শ্রীযুক্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের করকমলে’। ভারতীয় জনসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা হতে তখনও দশ বছর দেরি।