গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় :
মুখোমুখি দু’জন। অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারি এবং কেন্দ্রীয় রাজস্ব দফতরের বড় কর্তা অরুণ রায়। অর্থমন্ত্রী জানতে পেরেছেন, জনৈক ব্যক্তির আয়কর দফতরের খাতা অরুণ রায়ের কাছে রয়েছে। তাঁর সেটি দেখা প্রয়োজন। তিনি অরুণ রায়কে জিজ্ঞাসা করলেন, ওই ব্যক্তির আয়করের রিপোর্ট তাঁর কাছে আছে কিনা। অরুণ রায়ের উত্তর, হ্যাঁ, আছে। তারপর মোটামুটি যা কথাবার্তা হল তা এইরকম:
অর্থমন্ত্রী- ওই রিপোর্টটা আমার কাছে একবার পাঠাবেন তো।
অরুণ- না, ওটা তো পাঠাতে পারব না।
অর্থমন্ত্রী- সে কি? আপনি রিপোর্টটা পড়েননি?
অরুণ- হ্যাঁ, পড়েছি বইকি।
অর্থমন্ত্রী- তাহলে আমার কাছে পাঠাবেন না কেন?
অরুণ- পাঠাতে অসুবিধে আছে।
অর্থমন্ত্রী- আমি তো আপনার বস নাকি?
অরুণ–হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি আমার বস, কিন্তু ভারতের আয়কর দফতরের মাথায় তো রয়েছি আমি, আপনি নন।
না, কাহিনি এখানেই শেষ নয়। কাহিনির পরিণতি হল, অরুণ রায় নিজের পদেই বহাল রইলেন, তাঁর পদাবনতি হল না, তাঁকে আন্দামানে বদলিও করা হল না।
যাঁরা এ রাজ্যের পদস্থ আধিকারিক বা আমলা, তাঁদের অনেকেরই এ কাহিনি জানার কথা, কারণ বি কে নেহরুর আত্মজীবনীতে এ ঘটনার উল্লেখ আছে। এবং আমলারা সে বই পড়েনি বলতে গেলে তাঁদেরই লজ্জা পেতে হবে।
যেভাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন জেলায় গিয়ে প্রশাসনিক দরবার বসাচ্ছেন, সে প্রসঙ্গেই উক্ত কাহিনির অবতারণা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আদ্যন্ত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তা আশা করি আলিমুদ্দিন এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা, (যাঁরা আগে তাঁকে বিবিধ অপমানকর অভিধায় ভূষিত করতেন) ইতিমধ্যে মেনে নিয়েছেন। সেই কারণে তাঁর প্রতিবাদী সত্তাকে পিছনে ফেলে এখন প্রশাসনিক সত্তাকে সামনে আনছেন। তাতে সাধারণের কাছে এই বার্তা পৌঁছচ্ছে যে, কাজের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। কিন্তু সংশয় সেখানে নয়। মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে জেলায় জেলায় প্রশাসনিক দরবার বসিয়ে সকলের সামনে প্রশাসনিক কর্তাদের দুরমুশ করছেন এবং রাজ্যের ওপর মহলের কর্তারা ‘ইয়েস ম্যাডাম, ইয়েস ম্যাডাম’ বলে মাথা চুলকোচ্ছেন, প্রশ্নটা সেখানেই। যেমন ধরা যাক, স্বাস্থ্যসচিবকে মুখ্যমন্ত্রী সকলের সামনে তুলোধনা করলেন, কেন এক বছর আগে তাঁকে দিয়ে উদ্বোধন করিয়েও একটি বিশেষ প্রকল্প আজ পর্যন্ত চালু হল না। সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু স্বাস্থ্যসচিব আমতা আমতা করে তাঁর জবাব দিতে গিয়েও শেষ করতে পারলেন না, তার আগেই, মুখ্যমন্ত্রীর নিদান, সাতদিনের মধ্যেই সে কাজ শেষ করতে হবে। খুব ভাল কথা, স্টেরয়েডে কাজ হলে প্যারাসিটামলে কাজ কী? কিন্তু সত্যিই সে কাজ সাতদিনের মধ্যে শেষ হবে তো! স্বাস্থ্যসচিব আত্মপক্ষ সমর্থনে যা বলতে চাইছিলেন, বলতে পারলেন না। এবার, সাতদিনের মধ্যে যদি প্রারব্ধ কাজ শেষ না হয়, তাহলে কী হবে? কার গর্দান যাবে? গর্দান যাওয়ার ভয়ে যদি কাজ হয়ও, হাতে কি দুধেল গাইয়ের সর পড়া দুধ থাকবে, নাকি সেখানে কর্পোরেশনের খাঁটি জলও মেশানো থাকবে?
এখানে শুধু স্বাস্থ্যসচিবের কথা বলা হচ্ছে না,
যে-কোনও আধিকারিকের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। মুখ্যমন্ত্রী এভাবে সর্বসমক্ষে নিজের প্রশাসনিক কর্তাদের ধরে ধরে বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পর রাজ্যের সিংহভাগ মানুষের সমর্থন পাবেন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, আমরা, অর্থাৎ সাধারণ মানুষ, যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁরা মনে করি, সরকারি কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের অধিকাংশের প্রধান কর্তব্য, মাসের শেষে পাসবইয়ে মাইনের অঙ্কটি মিলিয়ে নেওয়া, (বিস্মরণযোগ্য এককালে, যখন সুরেন্দ্র সিং আলুওয়ালিয়া কংগ্রেসে, তখন দিল্লিতে আমাকে বলেছিলেন, সরকারি কর্মীরা আদতে ‘রাজার জামাই’)। এমতাবস্থায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী আমজনতার মনের কথাটিতে যদি সিলমোহর বসিয়ে দেন, তাহলে বুঝতে হয়, এ রাজ্যে প্রশাসনিক নৈরাজ্য আসতে আর দেরি নেই। এর একটি অন্য দিকও আছে। ধরা যাক, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। প্রশাসনের মাথায় যাঁরা আছেন, তাঁরা কাজ করতে চাইছেন, কিন্তু কিছু সমস্যার ঠেলায় বল মাঝমাঠ থেকে সামনে এগোলেও তেকাঠিতে ঢুকছে না। অথচ তাঁরা মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারছেন না অথবা বলছেন না। তাহলে অবস্থা আরও গুরুতর। বুঝতে হবে, হয় তাঁদের মস্তিষ্কের তরঙ্গপ্রবাহ বলে দিচ্ছে, যা চলছে চলতে দাও, নতুবা তাঁদের পিঠে কশেরুকা বলে যে বস্তুটি থাকে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যেই তা ভেঙে পড়বে।
দু,টিই এ রাজ্যের পক্ষে মারাত্মক। এইসময়, নিদেনপক্ষে একটি অরুণ রায়ের বড়ই প্রয়োজন এ রাজ্যের।