গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
রাজা থাকলে প্রজারাও থাকবেন, তেমনটাই নিয়ম। প্রজারা আছেন বলে বছর ঘুরলে একটি করে প্রজাতন্ত্র দিবসও নিয়মমাফিক এসে যাবে। সে নিয়মের ব্যত্যয় নেই। যেমন দুর্গাপুজো আসে, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে বড়দিন আসে, রমজানের পর ঈদের নমাজ আসে, তেমন প্রজাতন্ত্র দিবসও নিয়ম মেনে আসে-যায়। প্রজাদের হাতে প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে একটি মূল্যবান উপহার বরাদ্দ হয়। বৎসরান্তে শীতের নরম রোদ্দুরে গা সেঁকে নেওয়ার ছুটি পাওয়া যায়।
এহ বাহ্য। বাকি সবই যেমনকার তেমনই থাকে। আলুর দাম বাড়ে, পেয়াজের মূল্যবৃদ্ধি হয়, এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী গা শিরশির করা শিল্প মেলা উপহার দেন আর প্রধানমন্ত্রীর তো কথাই নেই। মন কি বাত শুনিয়ে দিল খুশ করে দেন। এ দেশের সংবিধানে রাজাদের রাজ্যপাট উঠে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু রাজাদের ঠাটবাট, আদব-কায়দা রপ্ত করে মন্ত্রী, পারিষদেরা গদিতে বসেছেন, বিপরীতে প্রজারা থেকে গিয়েছেন, যেমনটি থাকার তেমনটিই। ফলে সমাজ জীবনে খুব একটা ইতরবিশেষ দেখা যায় না। অনেকেই এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে প্রশ্ন তুলতে পারেন, কেন এখন কি জীবনযাত্রা আগের থেকে মসৃণ হয়নি? এখন কি শহরের বাড়িতে বাড়িতে সেলফোন, টিভি, ফ্রিজ কম দেখা যাচ্ছে? কথাটা হয়তো ভুল নয়। কিন্তু প্রজাদের জন্য প্রজাতন্ত্র দিবসে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, অর্থাৎ নাগরিকদের মৌলিক স্বাধীনতা, সেটাই ক্রমে কম পড়ে যাচ্ছে নাকি? আগামীতে হয়তো তা শুন্যের কোঠায় দাঁড়াবে। ফলে প্রজাতন্ত্র দিবসের সারমর্ম লিখতে বললে, তখন রাজতন্ত্রের রবরবার কথাই স্থান পাবে, প্রজাদের জন্য পড়ে থাকবে ফুটনোট।
রাজারা চলে যাওয়ার পর মন্ত্রী-সান্ত্রীরা এখন প্রবল পরাক্রমী। এ রাজ্যে যেমন তৃণমূল, কেন্দ্রের তেমন বিজেপি। মমতা বা মোদি রাজনৈতিক বিরোধীদের জন্য সূচ্যগ্র জমি ছাড়তে নারাজ।কাজেই প্রজারা দুই ক্ষমতাশালীর মধ্যে পড়ে খেই হারাচ্ছেন। রাজনীতির এই মুখর কলহ এবং উন্মুক্ত রক্তহোরি খেলার মধ্যে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন হতভাগ্য প্রজারা। প্রজাতন্ত্রের ট্র্যাজেডিটা সেখানেই। কথা ছিল, সকলে দুমুঠো খেতে পাবেন এবং সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবেন। বুকে হাত রেখে কেউ বলতে পারবেন না, এর কোনওটাই সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। টিভি-ফ্রিজের সমাজের বাইরে যে বৃহৎ জনগোষ্ঠী রয়েছে সেখানে বি পি এল কার্ড পৌঁছয় না, বিধবা ভাতার টাকা মাঝপথে হাপিস হয়ে যায়, স্কুলবাড়ির ভিতরে শিশুবলি হয়। সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে হলে প্রজাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়। পরিসংখ্যান দেওয়ার প্রয়োজন নেই, সকলেই জানেন, যে আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম নই। নিজের মনের কথা বলতেও আমাদের অক্ষমতা প্রবল।
দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে এ দেশ দুই ভাগ হয়েছিল। তারপরেও সাম্প্রদায়িকতার বিষে জর্জরিত এ দেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মোহনদাস বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের প্রকৃত পরীক্ষা হবে তখনই যখন সে দেশের জাতীয়তাবাদী মুসলিম, খ্রিশ্চান এবং হিন্দুদের প্রতি তার ব্যবহার বোঝা যাবে। তাছাড়া মুসলিমদের মধ্যেও বিভিন্ন সম্প্রদায় আছে; আছে শিয়া এবং সুন্নি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়। তাদের সকলের প্রতি সে কীরকম ব্যবহার করে তাও দেখতে হবে।’ সেখানে আশার বাণী শুনিয়ে জিন্না জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান মুসলিমের দেশ হবে, হিন্দুদের দেশ হবে, খ্রিশ্চানেরও দেশ হবে। তিনি দেখে যেতে পারেননি, কীভাবে তাঁর সাধের পাকিস্তান জাতিগত এবং সাম্প্রদায়িক হিংসার কবলে পড়ে বিনষ্ট হয়েছে। সেই একই হিংসার কবলে পড়ে প্রাণ দিয়ে গিয়েছেন মোহনদাস। সেই হিংসা কমা দূরে থাকুক, ক্রমেই বাড়ছে।
যে কোনও দেশ সৃষ্টি হয় তার অধিবাসীদের দিয়ে, সংস্কৃতি দিয়ে। অধিবাসীরাই যদি প্রজা হিসেবে নিজেদের দেশের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি পেতে অস্বীকার করেন তখন প্রজাতন্ত্র দিবসের অর্থ থাকে না। যাঁরা এ দেশ ছেড়ে বাইরে গিয়ে সংসার পাতেন, তাঁরা যদি নিমেষে এ দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তাঁদের মনের অভ্যন্তরে যদি দেশের প্রতি কোনও অধিকারবোধ বা স্বাভিমান না তৈরি হয় তাহলে বুঝতে হবে এ দেশ তাদের স্বাদেশিকতা শেখাতে পারেনি। আর, গণতান্ত্রিক সরকার যদি রাজা এবং প্রজার মধ্যে ব্যবধান না ঘুচিয়ে প্রজাদের মধ্যে হিংসা, দ্বেষ আর মালিন্যের বিষবাষ্প ভরে ঘরের মধ্যে ঘর নির্মাণে তৎপর থাকেন তাহলে প্রজাতন্ত্র দিবস পালনও অর্থহীন হয়ে পড়ে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
https://www.youtube.com/channelhindustan
https://www.facebook.com/channelhindustan