রণবীর ভট্টাচার্য:
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বলতে গেলে জীবনের প্রথম দিকের বড় পরীক্ষার কথা বলতে গেলে এগুলোর কথা না বললেই নয়। তাই বাঙালি জীবনে এই পরীক্ষাগুলো, তার প্রস্তুতি, ফলাফল যে বড় ভূমিকা নেয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল ঘোষণা হলে, এবং ভয়ানক করোনার মধ্যে কিছুটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে থেকেও অনেকে অগ্রসর হবে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষায়। কিন্তু সমস্ত টিভি চ্যানেল বা খবরের কাগজ কিম্বা অগুনতি পোর্টালে চোখ বুলালে খেয়াল হবে চিরচারিত এক তুলনা – গ্রাম বনাম শহর, আরেকটু পরিষ্কার করে বললে কলকাতা বনাম গ্রামের ফলাফলের তুলনা। এই তুলনামূলক আলোচনা কি সত্যি প্রাসঙ্গিক না স্রেফ ‘বাজারি খবর করার’ কৌশল?
কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী এবং অন্যান্য জেলার চেয়ে ভারত ও সারা বিশ্বের সাথে অনেক বেশি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তাই কলকাতার পরিকাঠামোর উন্নতি হয়েছে নিয়মিত এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকেছে। শুধু তাই নয়, রাজ্যের ভরকেন্দ্র হিসেবে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য, শিক্ষার ক্ষেত্রেও এটি বড় বাস্তব কিন্তু তাই বলে সমস্ত প্রকল্প কলকাতাতে হয়, এটাও সঠিক নয়। দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ এর মত মেগাসিটি হিসেবে কলকাতা প্রাধান্য পেলেও রাজ্যের দিক থেকে আর বাকি জেলার মত বরাদ্দ থাকে কলকাতাতেও। তাহলে এই মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিকের ফলাফল ঘিরে যেই আলোচনা হয়, সেখানে কলকাতাকে হেয় করে দেখানোর প্রবনতা কেন থাকে? আসল প্রতিযোগিতা কি ইংরেজি বনাম বাংলা মাধ্যমের?
বলাই বাহুল্য, কলকাতায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়েছে। বেসরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল প্রায় নেই বললেই চলে, বাংলা মাধ্যম বলতে রয়ে গেছে সরকারি স্কুল বা সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলগুলো। নব্বই এর দশক থেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ার হিড়িক পরে যায় আর তারই ফলশ্রুতি আজকের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠা কলকাতা। তবে এর সাথে সাথে মানসিকতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও যুক্ত অনেকটাই। এছাড়া ভবিষ্যতে চাকরির দিক নিয়ে মানুষের ভাবনা এই ট্রেন্ড তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভাবার বিষয় হল যে অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রে কত নতুন স্কুল হয়েছে এর মধ্যে এবং সেখানেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর প্রবনত রয়েছে কিনা।
যেই পক্ষের সরকারই হোক, পশ্চিমবঙ্গে কি সত্যি কলকাতা-কেন্দ্রিক উন্নতি বা সুযোগ সুবিধা বেশি হয়ে থাকে? যেভাবে এখনও ছেলেমেয়েদের কলকাতার কলেজে পড়ার দিকে বিশেষ লক্ষ্য থাকে, তাতে বাস্তবিক কলকাতা ও অন্যান্য জেলার তুলনা এসেই যায়। অংকের নিয়ম মেনেই শহর কিম্বা গ্রাম, সর্বত্রই যে মেধাবী ছেলেমেয়ে থাকবে, এই নিয়ে কোন দ্বিমত হতে পারে না। কিন্তু যেভাবে সংবাদমাধ্যমে কলকাতার ছেলে মেয়ের ফলাফলকে হেয় করে দেখানোর ট্র্যাডিশন চলে আসছে, তাতে ‘আবারও জেলার জয়জয়কার’ জাতীয় খবর প্রশ্ন তুলে দেয় সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। ভুললে চলবে না, কলকাতার অনেক নামজাদা স্কুল কিন্তু ইতিমধ্যেই সিবিএসই কিম্বা আইসিএসই / আইএসসি মাধ্যমের দিকে চলে যাচ্ছেন। মেধা তালিকা উচিত কি অনুচিত সেটি আলাদা প্রশ্ন, কিন্তু কলকাতাকে মেধাতালিকায় পিছিয়ে রাখার প্রবনতা যদি আদপে থাকে, তাহলে তা দুঃখজনক বটে। আর যাই হোক, শিক্ষা সমাজে সাম্য আনে, বৈষম্য তৈরি করে না।