গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় :
সালটা ১৯৫৬। প্রখ্যাত আইনজীবী মোতিলাল শেতলাবাড় পৌঁছেছেন হাগ, সেখানে আন্তর্জাতিক আদালতে সওয়াল করবেন তিনি। সেখানকার তদানীন্তন রাষ্ট্রদূত তাঁর কাছে গিয়ে একটি আবেদন পেশ করলেন, ওই আদালতের বিচারপতি, মহম্মদ জাফারুল্লা খান পুরনো পরিচয়ের জেরে শেতলাবাড়ের সঙ্গে দেখা করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন এবং আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। শেতলাবাড় ফোন তুলে জানিয়ে দিয়েছিলেন, যে মামলায় তিনি সওয়াল করবেন সেখানে আফারুল্লা অন্যতম বিচারপতি, কাজেই তাঁর সঙ্গে মামলা চলাকালীন দেখা করার প্রশ্নই ওঠে না।
শীর্ষ আদালতের যুযুধান বিচারপতিদের নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তাতে দেখা যাচ্ছে এক পক্ষের সঙ্গে যখন প্রধানমন্ত্রীর সচিবের আলাপচারিতার কথা শোনা যাচ্ছে তখন অন্য পক্ষের এক বিচারপতির সঙ্গে সিপিআই নেতা ডি রাজার করমর্দনের ছবি দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ যে শীর্ষ আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে আমাদের মতো খুচরো মানুষেরা শ্লাঘা বোধ করি তার দিনও বোধকরি শেষ হয়ে এল। যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশে দলীয় রাজনীতির চেয়েও বড় হল আইনের শাসন। সেই আইনের শাসনের মূল রাশ যাদের কাছে থাকে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল বিচারব্যবস্থা। সেই বিচারব্যবস্থার সামনেই যদি প্রশ্নচিহ্ন দাঁড়িয়ে যায় তাহলে দেশের অনাগত ভবিষ্যতের পক্ষে তা মোটেই মঙ্গলদায়ক নয়।
শীর্ষ আদালতের চারজন প্রবীণ বিচারপতি- রঞ্জন গগৈ, জাস্তি চেলমেশ্বর, মদন লোকুর এবং কুরিয়ন জোসেফ- প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন তা যেমন মারাত্মক তেমনই দুশ্চিন্তার। তাঁদের অভিযোগ সকলেরই প্রায় জানা হয়ে গিয়েছে, তবু একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক। তাঁদের অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টের কাজকর্ম মোটেই রীতি মেনে হচ্ছে না, কোন মামলার শুনানি কোন বেঞ্চে হবে বা কোন বিচারপতিরা সেখানে বিচার করবেন তা নিয়ে সিদ্ধান্তের পিছনে যুক্তি বা নীতি অমান্য করা হচ্ছে।যে মামলা বিক্ষুব্ধ বিচারপতিদের পাখির চোখ সেই মামলায় নাম জড়িয়েছে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের। কাজেই বিতর্কের আঁচ ছড়িয়েছে কংগ্রেস, বিজেপি এবং বামপন্থীদের আঙিনায়।
ভুয়ো সংঘর্ষে সোহরাবুদ্দিনকে মেরে ফেলার অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হয়েছিল সেই মামলার বিচারক ব্রিজগোপাল লোয়ার মৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন আছে। ওই বিচারকের মৃত্যুর তদন্ত নিয়ে করা মামলায় নিযুক্ত বিচারপতি অরুণ মিশ্রকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চার বিচারপতি।তাঁদের অভিযোগের সারবত্তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা অমিত শাহের নাম যেহেতু ওই মামলায় আছে সেই কারণেই মামলাটিতে প্রধান বিচারপতি বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন।শুধু ওই মামলাই নয়, অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও দীপক মিশ্র যেভাবে বিচারপতি নিয়োগ করছেন তাতে নিরপেক্ষতার অভাব দেখা যাচ্ছে। অভিযোগ যথেষ্ট গুরুতর সন্দেহ নেই কিন্তু যেভাবে সমস্ত প্রসঙ্গটি দেশবাসীর সামনে এল তা কি অভিপ্রেত ছিল?
চেলমেশ্বর বলেছেন, বিবেকের তাড়নায় তাঁরা সাংবাদিক সম্মেলন করে বিচারবিভাগের অন্দরের কথা বারমহলে টেনে এনেছেন। একবার মনে করা যাক বিচারপতি এইচ আর খান্না কী করেছিলেন। জরুরি অবস্থার সময় তিনি সরকারের আনা বিল সমর্থন করেননি। তিনিই একমাত্র যিনি জরুরি অবস্থায় বিনা বিচারে আটক করার বিরুদ্ধে নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে জানিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় যাঁরা বিশ্বাসী তাঁদের কাছে এই বিল অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসবে। এর পরে তাঁকে অনেক বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, কিন্তু তিনি বিচারবিভাগকে বারমহলে টেনে আনেননি। যদি বিক্ষুব্ধ বিচারপতিরা বিবেকের তাড়নায় পদত্যাগ করে সর্বসমক্ষে সমস্ত বিষয়টি নিয়ে আসতেন তাহলে সত্যই ভারতীয় গণতন্ত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ পেত। তাঁরাও এটা প্রমাণ করতে পারতেন, দীপক মিশ্র যে পথে হাঁটছেন তাঁরা সেই একই পথ অনুসরণ করতে চান না।
ক্ষমতার অলিন্দে থেকেও প্রতিবাদের সুযোগ থাকে, বিক্ষুব্ধ বিচারপতিদের অভিযোগ, সে পথ তাঁদের বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কারণ প্রধান বিচারপতি তাঁদের দেওয়া অভিযোগপত্র পেয়েও গা করেননি। প্রধান বিচারপতি যদি তা করে থাকেন, তাহলে বিক্ষুব্ধ বিচারপতিরা একযোগে পদত্যাগ করে সংবাদ মাধ্যমের সামনে এলে দীপক মিশ্রের পক্ষে সেই চাপ সহ্য করা রীতিমতো কঠিন হত। বিক্ষুব্ধ বিচারপতিরাও প্রমাণ করতে পারতেন, সত্য বা নিরপেক্ষতার প্রকাশে অনমনীয়তার যেমন প্রয়োজন তেমন ত্যাগ স্বীকারেরও প্রয়োজন। তার ফলে ভবিষ্যতে বিচারক লোয়ার মৃত্যুর তদন্ত দাবি করা মামলা সরকারের কাছে স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে উঠত। এখন সমগ্র বিষয়টি খানিকটা দলীয় রাজনীতির চেহারা পেল এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস খানিকটা টাল খেয়ে গেল, এবং তদুপরি বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা বিতর্কে বিষয় হয়ে গেল, যা মোটেও অভিপ্রেত ছিল না