Breaking News
Home / TRENDING / প্রথম ব্র‍্যান্ডেড নায়িকা কানন দেবী (১৯১৬-১৯৯২)

প্রথম ব্র‍্যান্ডেড নায়িকা কানন দেবী (১৯১৬-১৯৯২)

কমলেন্দু সরকার ঃ

জন্ম হাওড়ায়। বাবা রতনচন্দ্র দাস। মায়ের নাম জানা যায় না। আগের দুই সন্তান মারা যায়। তাই মেয়ের নাম দিলেন মা মেথরানি। কিন্তু মেয়ে ছিল এক ফুটফুটে সুন্দরী। মাত্র দশ বছর বয়সে অভিনয় জগতে এসেছিলেন কানন দেবী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ”ছবির পরদায় আত্মপ্রকাশের প্রথম সুযোগ ঘটে ‘জয়দেব’-এ (১৯২৬), শ্রীরাধার ভূমিকাটি আমায় দেওয়া হয়েছিল। তখন আমার বয়স মাত্র এগারো কি বারো বৎসর। তারপর দর্শকমণ্ডলীপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে নিজের ছবি পর্দায় দেখলুম এবং দেখলুম আমিও হাত, পা, মুখ নাড়ছি পর্দার ওপর—- তখন আমি বালিকা।”

ম্যাডান থিয়েটারে কানন দেবী এসেছিলেন তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। এই ‘জয়দেব’ ছবির পরিচালক ছিলেন জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সময়টা ১৯৩১। এবার কানন দেবী নায়িকা। ছবির নাম ‘ঋষির প্রেম’। ম্যাডান কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হল মাসে ষাট টাকায়। তিনি পুরুষ ভূমিকাতেও অভিনয় করেছেন একাধিকবার। যেমন ‘প্রহ্লাদ’-এ নারদ, পৌরাণিক ছবি ‘বিষ্ণুমায়া’-তে দুটি চরিত্র। একটি কৃষ্ণ অন্যটি নারায়ণ। ‘কংসবধ’ ছবিতেও তিনি ছিলেন পুরুষ চরিত্রে। ‘শঙ্করাচার্য’ ছিল ম্যাডানের শেষ ছবি। এই বছরেই প্রথম সবাক ছবি ‘জোরবরাত’-এ নায়িকা।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩২-এ কানন দেবী যোগ দিয়েছিলেন রাধা ফিল্মস-এ। যে-রাধার ভূমিকায় প্রথম অভিনয় সেই রাধা নামের প্রতিষ্ঠানে এসে কানন দেবীর মাসিক চুক্তি হল ৩০০ টাকায়। ৬০ টাকা ৩০০ টাকা লাফ দিয়েছিলেন তিনি! এটা ভাবাই যেত না!
১৯৩৩-এ কানন দেবী আর-এক প্রতিভা আবিষ্কার হল। গায়িকা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’ ছবিতে বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় অভিনয়ের পাশাপাশি গান গেয়ে মাত করে দিয়েছিলেন।
এভাবে ছবি ধরে বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। এত বড় ছিল কানন দেবী অভিনয় জগতের পরিধি! অভিনয়ের সঙ্গে গানও গাইতে শুরু করেছিলেন পরদার বাইরে। মেগাফোন কোম্পানির প্রাণপুরুষ জেএন ঘোষ তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করেলেন। ট্রেনার ছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। কানন দেবী উচ্চাঙ্গসংগীত শিখেছিলেন ওস্তাদ আল্লারাখার কাছেও।
কানন দেবী ক্রমশ বাঙালির কাছে হয়ে উঠেছিলেন হার্টথ্রব। কানন দেবীর নামেই বক্স-অফিস হিট হত। ১৯৫৯ পর্যন্ত প্রচুর ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। কানন দেবীই হলেন বাংলা ছবির প্রথম ব্র‍্যান্ডেড নায়িকা। ১৯৪৭-এর ৬ অগস্ট বিলেত গেলেন। তৎকালীন ভারতের হাইকমিশনার কৃষ্ণ মেনন আয়োজিত সংবর্ধনাসভায় ইন্ডিয়া হাউসে ১৫ অগস্ট জাতীয়পতাকা উত্তোলন করা হয়। ওই সভায় কানন দেবী গান গেয়েছিলেন ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’। এরপর তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন হলিউড। সেখানে তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছিল হলিউড গ্রামোফোন কোম্পানি। সেখানে অলাপ হল ভিভিয়ান লে, ক্লার্ক গ্যাবল, ক্যাথারিন হেপবার্ন প্রমুখ বাঘা বাঘা অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে।
১৯৪৯-এ কানন দেবী ছবি প্রযোজনায় এসেছিলেন। প্রযোজনা সংস্থার নাম দিলেন— শ্রীমতী পিকচার্স। এই সংস্থার প্রথম ছবি ‘অনন্যা’। বহু ছবি প্রযোজনা করেছিলেন কানন দেবী। তার মধ্যে ‘আঁধারে আলো’ (১৯৫৮) দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ছবির জন্য রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পেয়েছিল। এবং ছবিটি কার্লোভি ভ্যারি ফিল্মোৎসবে মনোনীত হয়েছিল। ওই উৎসবে তিনি গিয়েছিলেন সঙ্গে ছিলেন স্বামী হরিদাস ভট্টচার্য। হরিদাস ভট্টাচার্য ছিলেন তৎকালীন পশ্চিম বঙ্গের রাজ্যপাল কৈলাসনাথ কাটজু-র এডিসি। এর আগে কানন দেবীর বিয়ে হয়েছিল ব্রাহ্মসমাজ-এর নেতৃস্থানীয় হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পুত্র অশোক মৈত্রের সঙ্গে। তবে এ বিয়ে বেশিদিন টেকেনি।
১৯৬৮-তে সম্মানিত হয়েছিলেন পদ্মশ্রী সম্মানে। ১৯৭৬-এ ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পেয়েছিলেন। আগে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলে বিএফজেএ-র। ১৯৯০-এ সিনে সেন্ট্রাল তাঁকে দিয়েছিল হীরালাল সেন পুরস্কার। ১৯৯১-এ পেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার। ১৯৯২-এ প্রয়াত হলেন বাংলা ছবির সেরা নায়িকা-গায়িকা কানন দেবী। তিনি যেখান থেকে এসে যে-উচ্চতায় উঠেছিলেন তার বেশি উদাহরণ বাংলা তো বটেই ভারতীয় সিনেমা দুনিয়ায় নেই।

তিনি নিজের সম্প্ররকে খুব সুন্দর কথা বলেছিলেন—- অভিনয় করাকে আমার জীবনের ব্রত বলে মনে বরণ করে নিয়েছি, সফল হতে পারব কিনা জানি না। তবে আমি যে আমার এই জীবন দেশের একটা কলাবিদ্যায় উৎসর্গ করতে পেরেছি এই আমার ভাগ্য বলে মনে করি। আমার জীবনে এর চেয়ে আর কোনো বড়ো কামনা নেই।
এই কথাটা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। ১৯৭৩-এর বৈশাখে তাঁর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’ প্রকাশিত হয়েছিল।

Spread the love

Check Also

চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক

ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …

আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ

জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …

নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই

সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *