কমলেন্দু সরকার :
সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ মুক্তি পেল ১৯৬৭-র ২৯ সেপ্টেম্বর। রাধা, পূর্ণ, অরুণায়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কাহিনি এই প্রথম ছবি করলেন তিনি। ১৩টি ছবির করার পর গোয়েন্দা কাহিনি নিয়ে তাঁর প্রথম কাজ। ব্যোমকেশ বক্সির ভূমিকায় উত্তমকুমার। উত্তমকুমার তখন বাংলা ম্যাটিনি আইডল। যদিও আগের বছরই উত্তমকুমারকে নিয়ে করেছিলেন ‘নায়ক’। সে এই নায়ককে নিয়েই। কিন্তু ব্যোমকেশের চরিত্রে নেবে কী বাঙালি দর্শক! এ নিয়ে পরিচালকের কোনও মাথা ব্যথা ছিল। থাকার কথাও ছিল না সত্যজিৎ রায়ের কাছে।
ব্যোমকেশ চরিত্রে পরিচালকের নির্বাচন ঠিক ছিল তা প্রকাশ পেল ‘চিড়িয়াখানা’ রিলিজের পর। উত্তমকুমারকে খুব ভাল ভাবেই নিয়েছিল বাংলা ছবির দর্শক। অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন তিনি। তাই সেরা নায়কের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। তখন সেরা নায়কের পুরস্কারের নাম ছিল ভরত পুরস্কার। তবে ‘চিড়িয়াখানা’র সঙ্গে ছিল আরও একটি ছবি ‘আন্টনি ফিরিঙ্গি’। এই দু’টি ছবির সুবাদেই উত্তমকুমার পেয়েছিলেন ভরত পুরস্কার।
‘চিড়িয়াখানা’র প্রযোজক ছিলেন হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তাঁর ছিল ফুলের ব্যবসা। উত্তর চব্বিশ পরগনার বামনগাছিতে ছিল তাঁর বিশাল জমিতে ফুলের চাষ। বিভিন্নরকম ফুলের চাষ করতেন ওই জমিতে। ১৯৬৬-র জুনের শেষের দিকে ‘চিড়িয়াখানা’র সেট পড়ল সেখানে। সত্যজিৎ রায়ের শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত সেট বানালেন। গোলাপ কলোনির লোকেদের থাকার জন্য ঘরবাড়ি, গোলাপ কলোনি মালিকের বাংলো মতো তৈরি করেছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত। ইন্ডোর শুটিং হয়েছিল স্টুডিয়োতেই।
‘চিড়িয়াখানা’র শুটিং চলাকালীনই হার্ট আটাক হয়েছিল উত্তমকুমারের। এই ছবিতে ছিলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি উত্তমকুমারকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপার সুবিধের নয়। এ প্রসঙ্গে আমাকে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমি উত্তমদার অবস্থা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম হার্ট আটাক করেছে। আমি তখন পাশ করা ডাক্তার। হাতের কাছে ওষুধ ছিল দিলাম। সঙ্গেসঙ্গে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হল ডাক্তার সুনীল সেনের কাছে। উত্তমদা সে যাত্রা খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলেন। সেই আমাকে উনি ভীষণই ভালবাসতেন। আর বলতেন, ‘তুই আমাকে নতুন জীবন দিয়েছিস।’ তারপর আমাদের দু’জনের সম্পর্ক খুব নিবিড় হয়েছিল।”
এর কিছুদিন পরই সত্যজিৎ রায় আর উত্তমকুমার বার্লিন গেলেন। ‘নায়ক’ আমন্ত্রিত ছিল বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ। সব মিলিয়ে কিছুদিন বন্ধ থাকল ‘চিড়িয়াখানা’র শুটিং।
বেশ কিছুদিন পর শুরু হল আবার ‘চিড়িয়াখানা’র শুটিং। আগে যেমন মোটামুটি নির্বিঘ্নে শুটিং চলছিল, এবার অতটা সহজ হল না। খবর রটতে দেরি হল না। চারিদিকে জানাজানি হয়ে গেল। একে সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক, তার ওপর উত্তমকুমার! মানুষের ঢ্ল নেমে গিয়েছিল তৈরি করা গোলাপ কলোনিতে। গাছে উঠে, পাঁচিলে উঠে সবাই শুটিং দেখত। অসুবিধে হল শুটিংয়ের কাজে। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎজায়া বিজয়া রায় বলছেন ‘আমাদের কথা’য়, “দেওয়ালের ওপরে ক্যামেরা তোলা যেত না। কারণ তাহলেই লোকেদের বুক, কাঁধ চলে আসত।”
যাই হোক শেষ হল শুটিং। ‘চিড়িয়াখানা’ মুক্তি পেল। বক্স-অফিস সাফল্যও এসেছিল। সত্যজিৎ রায় পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় সম্মান। শোনা যায়, সত্যজিৎ রায় এই ছবি নিয়ে নিজে খুব-একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না।
Check Also
চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক
ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …
আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ
জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …
নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই
সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …