পার্থসারথি পাণ্ডা:
উপনিষদে গার্গী আর যাজ্ঞবল্ক্যের উপাখ্যান মনে আছে? সেখানে বিদুষী গার্গী ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে ব্রহ্মের স্বরূপ জানতে চেয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছিলেন। কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর ঋষির কাছে ছিল না। তাই মেজাজ হারিয়ে তিনি গর্জে উঠেছিলেন। গার্গীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, ‘এরপর আর প্রশ্ন করলে ধড় থেকে তোমার মাথা খসে পড়বে’! এভাবেই সেদিন চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল গার্গীকে। এভাবেই চুপ করিয়ে দেওয়া হত সেকালের নারীদের। আসলে মহামান্য মনুপন্থায় নারী মিথ্যের মতোই অপবিত্র ছিলেন। সেই ‘অপবিত্র’ নারীর বেদপাঠের অধিকারও মনু কেড়ে নিয়েছিলেন। তবুও তারই মাঝে, সেকালে গার্গীদের মতো নারীরা তাঁদের প্রজ্ঞা নিয়ে মাথা উঁচু করে পুরুষের পাল্লা দেবার শিক্ষা পেয়েছিলেন।
পুরুষের লেখা পুরাণ আর শাস্ত্রে নারী হয় কমনীয় বর্ণনায় ভোগের জন্য কাম্য অথবা অপবিত্রজ্ঞানে অস্পৃশ্য। শতপথ ব্রাহ্মণে তাকে তুলনা করা হয়েছে কুকুরের সঙ্গে। শাস্ত্রের গন্ডি আর পুরাণের গল্প দিয়ে নারীকে দমিয়ে রাখার চক্রান্ত চিরকালের। শরশয্যায় শুয়ে পিতামহ ভীষ্ম ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে নারীচরিত্র সসম্পর্কে যে জ্ঞান দান করেন, তার চেয়ে নারীজন্মের বড় অপব্যাখ্যা আর হয় না। ধর্মকথায় মানুষের চিরকালের আস্থা, তাই শাস্ত্রবাক্যে নারী বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল অনেক পাপে নারীজন্ম হয়। কারণ, মহাভারতে পিতামহ ও পার্থসারথি ঘুরিয়ে ফিরয়ে সেকথা বেশ কবার বলেছেন।
মুসলিম শাসনের প্রভাবে এসে নারীকে হঠাৎ করে অন্তঃপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়নি, এই প্রক্রিয়া চলেছিল দীর্ঘকাল ধরে। যাজ্ঞবল্ক্যরা নারীকে চুপ করিয়ে তার নাম দিয়েছিলেন ‘অবলা’। তারপর ইসলামি কালচার বরণ করে মাথায় ঘোমটা তোলা হল। মনুকে হাতিয়ার করে লেখাপড়া শিখলে বিধবা হবার ভয় ঢোকানো হল। মনু বা কৌটিল্য ব্যাভিচারি পুরুষের তুলনায় নারীর জন্য যেমন কঠোর দন্ডের বিধান দিয়েছিলেন, তেমনি সেই বিধান ঘুরিয়ে নারীর শ্রমমূল্য পুরুষের তুলনায় কমিয়ে দেওয়া হল।
পুরুষের গড়া গড়খাই থেকে নারীকে টেনে তুলতে নারী জাগরণের চেষ্টা শুরু হল উনিশ শতকে এসে। বিধবা বিবাহের জন্য লড়তে এসে বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন আইন দিয়ে হবে, শাস্ত্রান্ধ জাতিকে শাস্ত্র দিয়েই মারতে হবে। ফলে, শাস্ত্র ঘেঁটে তাঁকেও খুঁজতে হল বিধবাবিবাহের স্বপক্ষ যুক্তি। তা সত্ত্বেও মৌরুসি পাট্টা ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি বিধানদাতাদের সমাজ। যুক্তি পাল্টাযুক্তির কাজিয়ায় মেতে উঠেছিল। তারপর চলল বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এলো সহবাস সম্মতি আইন। চলল শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে জাগ্রত চেতনাকে ঘুম পাড়ানোর খেলা।
উনিশ শতকে শিক্ষাপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নারী শিক্ষারও প্রসার ঘটল। নারীরা ঘরের আগল ঠেলে স্কুল, কলেজে, কর্মক্ষেত্রের অঙ্গনে একে একে এগিয়ে আসতে লাগলেন। এই এগিয়ে আসার লড়াই আজ প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাস। তবু এখনো পুত্রলাভের ইচ্ছায় ইস্যুর পর ইস্যু নেওয়া হয়, কন্যাসন্তান জন্মের পর চোখে জল আসে, কন্যাসন্তান বিসর্জনের ট্রাডিশন বজায় থাকে। বয়স লুকিয়ে বাল্যবিবাহ হয়। এখনো পিতা হন ‘কন্যাদায়গ্রস্ত’ এবং বিয়ের পর মেয়েরা ‘উদ্ধার’ হয়। এখনো জারি অধিকার আদায়ের লড়াই। সমাজের শিরায় শিয়ায় যে বিরুদ্ধভাবনার স্রোত বইয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই সূদুর অতীতে, সেই স্রোতের গতিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়াটা এখনো বহু মানুষীর বহু সাধনার কাজ।
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
https://www.youtube.com/channelhindustan
https://www.facebook.com/channelhindustan