Breaking News
Home / TRENDING / বাঙালির পাতে ইলিশের আকাল

বাঙালির পাতে ইলিশের আকাল

 

কমলেন্দু সরকার  :

‘রুপোর পাতে মারে ঘা/পানির বুকে ফেলল পা। এই ধাঁধার উত্তর— ইলিশ মাছ। ইলিশ মানেই বাঙালি, বাঙালি মানেই ইলিশ। বাজারে গিয়ে চকচকে রুপোলি ফসলটি দেখলেই বাঙালির জিভ সকসক করে ওঠে। চোখের সামনে ইলিশ ভাপা, সর্ষে ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশভাজা আরও কত কী! আর ইলিশ যদি গঙ্গার হয় তাহলে তো কথায় নেই! গঙ্গার ইলিশের এত স্বাদ এ নিয়ে কমলকুমার মজুমদারের একটা দারুণ মন্তব্য ছিল— কোম্পানির তেল খেয়ে গঙ্গার ইলিশের স্বাদ বেড়েছে!
কিন্তু এবার বাঙালির পাতে গঙ্গার ইলিশ জুটবে কিনা সন্দেহ আছে। গতবছর  আসা-যাওয়ার পথে দু’চারটি গঙ্গার ইলিশ নিয়ে বসে আছেন স্থানীয় ধীবররা। এ বছর দেখছি গঙ্গার আড় ট্যাংরা আর কুচো মাছ ছাড়া কিছুই নেই। জিজ্ঞেস করতে একজন বললেন, একটাও ইলিশ উঠছে না জালে। সকাল থেকে গঙ্গায় জাল টানাটা বৃথা খাটুনি হচ্ছে। এইসব মাছ বিক্রি করে আর সংসার চালানো যায়!
বছর কয়েক ধরে এমন একটা হতাশার সুর শোনা যেত। কিন্তু এবার যেন হতাশাটা হাহাকার মনে হল। শোনা যাচ্ছে, গঙ্গার মোহনার কাছে এসে ঠিকানা বদল করে ইলিশের ঝাঁক রওনা দিচ্ছে পড়শি নদী পদ্মায় নয়তো বার্মা মুলুকে অর্থাৎ মায়ানমারে।
অনেকেই বলেন, গঙ্গার প্রতি অবহেলা এর প্রধান কারণ। পশ্চিমবঙ্গের বহু পুরসভার আবর্জনা, গঙ্গার ধারের কলকারখানার বর্জ্য মেশার ফলে নদীর দূষণ অত্যধিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই গঙ্গায় আর ইলিশ ফিরতে চায় না।
ইলিশকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা চলছে। এমনকী খোকা ইলিশ ধরলে এবং বিক্রি করলেই নাকি ফাইন গুনতে হবে। খোকা ইলিশ দেদার বিক্রি হতে দেখেছি এবং দেখি! ইলিশ বাঙালি জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। কী লোকজীবনে, কী সাহিত্যে! ইলিশ আমাদের সংস্কৃতির অংশ। ধীবরদের কাছে ইলিশ হল রাজর্ষি মাছ। প্রথম ধরা ইলিশটিকে জালের ওপর একটি থালায় সিঁদুর-হলুদ মাখিয়ে বরণ করা হয়। কেউ কেউ আবার ধূপধুনো আর ফুল-বাতাসা দিয়ে পুজোও করে। ইলিশ হল ধীবরদের কাছে সংসারের শান্তি। কারণ, ইলিশ মাছের দাম বেশি। দাম বেশি মানেই বেশি আয়। আয় বেশি হলেই সংসারে শান্তি বিরাজ করে। ময়মনসিংহ গীতিকায় রয়েছে— সেই ইলিশের দাম হইল সোনায় একুশ ভরি/মাছ ইলিশারে। আবার প্রচলিত আছে— সোনা নাচে কোনা/বলদ বাজায় ঢোল/সোনার বউ রেঁধেছে/ইলিশ মাছের ঝোল। এমন অনেক কিছু ছড়িয়ে রয়েছে ইলিশ নিয়ে ছড়া এবং গান।
বাংলো সাহিত্যে কত কিছু ছড়িয়ে রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! একশো বছরেরও কত আগে ‘কষ্টিপাথর’ নাটকে নাট্যকার রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—- নবীন জোড়া ইলিশ কিনে খুব খুশি। ও সেই জোড়া ইলিশ সকলকে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। পরিমল গোস্বামী তো ইলিশকে ভগবান বানিয়ে ছেড়েছিলেন। বুদ্ধদেব গুহর একটি গল্প সংকলনের নামই ‘ইলিশ’। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, জলের উজ্জ্বল শস্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তো ইলিশকে অন্যরূপে দেখিয়েছিলেন ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে। সবচেয়ে মজার সম্ভবত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপাল ভাঁড়ের সেই কথা। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বলছেন, ”গোপাল তুমি যদি নদীর পাড় থেকে ইলিশ কিনে রাজ দরবার পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে আসতে পারো, কিন্তু কেউ তোমাকে প্রশ্ন করতে পারবে না। এমন যদি হয় তোমাকে আমি পুরস্কার দেব “। গোপাল রাজি। গোপাল ইলিশ কিনে রাজ দরবারে এলেন। কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেনি। রাজা বললেন, এ কি করে সম্ভব গোপাল।


গোপাল বললেন, মাছে সুতো বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছি। তারপর নিজের ধুতি তুলে মাথা ঢেকে নিয়েছি। রাজ দরবারে এসে ধুতি নামিয়েছি। রাস্তায় সবাই বলাবলি করেছে, দেখ পাগল আবার ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে যায়!
এমন অনেক কিছু আছে ইলিশ নিয়ে। তাই বাঙালির জীবন থেকে ইলিশ যদি হারিয়েই গেল তো বাঙালির সংস্কৃতিও শেষ। খেলার সঙ্গেও ইলিশ জড়িয়ে রয়েছে। তাই গঙ্গাও বাঁচাতে হবে সঙ্গে ইলিশও। গঙ্গা বাঁচলে ইলিশও বাঁচবে।

Spread the love

Check Also

চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক

ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …

আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ

জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …

নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই

সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *