সোমা নাগ :
চতুর্থ পর্ব- – 6ই জুন সকাল 8টা 40এ পৌঁছে গেলাম সেন্ট পিটার্সবার্গ । ইলিনা,সেন্ট পিটার্সবার্গের ইংরেজি জানা,স্থানীয় ট্যুর গাইড আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল স্টেশনে। স্টেশন থেকে বেশ অনেকটা পথ হেঁটে এসে ভলবোতে উঠলাম।নেভা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত সেন্ট পিটার্সবার্গ,মস্কোর পর, রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। 1703 খ্রিস্টাব্দে জার সম্রাট ‘পিটার দ্য গ্রেট’এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা। তিনবার এই শহরের নাম পরিবর্তিত হয়। 1914তে পেট্রোগ্রাদ ,1924এ লেলিনগ্রাদ , 1991 সালে আবারও নাম পরিবর্তিত হয়– সেন্ট পিটার্সবার্গ । দুদশকের জার শাসনপর্বের রাজধানী ছিল বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী এই বন্দর-শহরটি। রাশিয়া একটি বৃহত্তম শিল্পকেন্দ্র,জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ শিল্প কারখানার শ্রমিক এবং বাণিজ্য সম্বন্ধীয় কাজে যুক্ত। হোটেল ‘পার্ক ইন’এ পৌঁছে, ব্রেকফাস্ট করে শহর ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম ।
প্রথমই চোখে পড়ল ‘পিটার দ্য গ্রেট’এর ‘Bronze Horseman’ মূর্তি,এটি সেনেট স্কোয়ারে প্রতিষ্ঠিত। বহুদূর থেকে দেখা যায় সেন্ট আইজ্যাক ক্যাথিড্রালটির ডোম।এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম অর্থোডক্স ক্যাথিড্রাল।এ ছাড়াও রয়েছে নেভা নদীর তীরে অবস্থিত স্মোলনি ক্যাথিড্রাল। দেখলাম রাশিয়ান ব্যালে ও অপেরার জন্য বিখ্যাত ম্যারিনিস্কি থিয়েটার। Kazan Chathedralএর পুরো নাম Chathedral of our Lady Kazan । ক্যাথিড্রালটি 1801থেকে1811খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত। ভার্জিন মেরি–,যাঁকে রাশিয়ার রক্ষয়িত্রী মনে করা হয় তাঁকেই এই ক্যাথিড্রালটি উৎসর্গ করা হয়েছিল।এর অভ্যন্তরে Lady Kazanএর আইকন চিত্র রয়েছে,যা চুম্বন করাকে পবিত্র স্পর্শ লাভ করা বলে মনে করেন দর্শনার্থীরা। তবে রাশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ক্যাথিড্রালটি হল-Colourful Church of the Savior on Spilled Blood.1883সালে তৃতীয় আলেকজান্ডারের সময় কালে এর নির্মাণকার্য শুরু হয়, সমাপ্তি ঘটে জার সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসের সময় 1907। চার্চটি জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের স্মৃতিতে উৎসর্গীকৃত হয়,কারণ এই ক্যাথিড্রালটি যে স্থানে অবস্থিত ঠিক তার সামনেই দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যু ঘটেছিল।
সেন্ট পিটার্সবার্গের আরেকটি দৃষ্টিনন্দন ক্যাথিড্রাল হল ট্রিনিটি ক্যাথিড্রাল। গঠনশৈলীগত দিক থেকে এটি Empire Style এর পর্যায়ভুক্ত। শুভ্রবর্ণের ক্যাথিড্রালটির নীল ডোম এক অপূর্ব ঔজ্জ্বল্য সৃষ্টি করেছে।1828 থেকে 1835 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত এই ক্যাথিড্রালটি 1990এ ইউনেস্কা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়।
নেভা নদীর তীরে বেশকিছুটা সময় কাটালাম আমরা। ভরাযৌবনের উচ্ছ্বলতায় গাঢ় নীল জলরাশির তরঙ্গমালাকে শরীরে ধারণ করে এ নদী বেশ বেগবতী। অপরাহ্নের মায়াবী আলোয় নেভা নদী যেন রূপসী রাজকন্যা। নদীর যে ঘাটটিতে এসে দাঁড়িয়েছিলাম তার দু-পাশে ছিল মিশরের স্ফিংসমূর্তি।
ক্যামেরায় দৃশ্যবন্দী করে বাসে উঠে পড়লাম,পরবর্তী গন্তব্য বন্দর অঞ্চলের উদ্দেশ্যে।
নেভা নদী সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গিয়ে Gulf of Finland এ মিশেছে । এই উপসাগরটি গিয়ে মিশেছে বাল্টিক সাগরে। ফলে বাণিজ্যিক বন্দর রূপে সেন্ট পিটার্সবার্গের গুরুত্ব অপরিসীম। তারই প্রতীক হিসেবে রয়েছে একটি মনুমেন্ট।পার্শ্ববর্তী পার্লামেন্ট হাউজের বিপরীতেই রয়েছে টিউলিপ গার্ডেন। নানা বর্ণের বিশেষত,টুকটুকে লাল টিউলিপ ফুলের অফুরন্ত সম্ভারে মুগ্ধতায় আবিষ্ট আমরা সকলেই।
প্রথম দিন সেন্ট পিটার্সবার্গ ভ্রমণের শেষ পর্বে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছে গেলাম নিকোলাইভস্কি প্যালেসে। রাজকীয় প্যালেসের একটি মঞ্চে ‘রাশিয়ান ফোক শো’ অনুষ্ঠিত হয়। বর্ণোজ্জ্বল পোশাক পরিহিত পুরুষ ও রমণীর প্রাণোচ্ছল সংগীত ও নৃত্যের কৃৎকৌশল আমরা সকলেই খুব উপভোগ করলাম।লোকসংগীত ও নৃত্যের এই অনুষ্ঠানের মাঝে বিরতিতে সৌজন্যমূলক খাদ্য ও পানীয় প্রদান করা হয়।
রাত্রি 11টা নাগাদ ফিরে এলাম হোটেলে।স্ক্যানডিনেভিয়াসহ রাশিয়ায় এপ্রিল থেকে আগস্ট-এর তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত নিশীথ সূর্যের অধ্যায় চলে,প্রচলিত ধারণা অনুসারে ছ’মাস দিন। তাই ঘড়ির সময় যাই বলুক না কেন নিয়মমতো রাতের অন্ধকার বলতে যা বুঝি তার দেখা পাওয়াই ভার।
পরদিন 7ইজুন সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের এমন কিছু দ্রষ্টব্যস্থানে ভ্রমণ করলাম, যার স্মৃতি চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে।(ক্রমশ)