সোমা নাগ :
অন্তিম পর্ব—7ই জুন সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে আমাদের দুটি অন্যতম দ্রষ্টব্য ছিল,এক–হার্মিটেজ মিউজিয়াম, দুই–রাশিয়ান স্টেট মিউজিয়াম। 1764খ্রিস্টাব্দে ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হার্মিটেজ মিউজিয়াম রাশিয়ার শিল্প-সংস্কৃতির এক অপরূপ সংগ্রহশালা।নেভা নদীর তীরে অবস্থিত এই মিউজিয়ামটির– উইন্টার প্যালেস, ক্ষুদ্র হার্মিটেজ,পুরনো ও নতুন হার্মিটেজ,হার্মিটেজ থিয়েটার সহ মোট 5টি ইমারতে যা কিছু সংরক্ষিত আছে তা সর্বসাধারণের দর্শনের জন্য খুলে দেওয়া হয় 1852খ্রীস্টাব্দ থেকে। ত্রয়োদশ থেকে বিংশ শতকের পশ্চিম ইউরোপীয় চিত্র-ভাস্কর্য-ফলিতশিল্প এই মিউজিয়ামের প্রায় 120কক্ষে সংরক্ষিত রয়েছে। একদিন কেন গোটা একটা সপ্তাহ লেগে যায়, পৃথিবীর বৃহত্তম ও প্রাচীনতম এই মিউজিয়ামটি ভালো করে দেখতে। মিউজিয়ামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে মার্বেল পাথরের,19.2টন ওজনের Kolyvan Vase। প্রধান সিঁড়িটির (Main Staircase) দেওয়াল ও ছাদের অভ্যন্তরগাত্রে সোনার পাতের চোখধাঁধানো কারুকাজ বিস্ময় সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় নিকোলাসের স্ত্রী আলেকজান্ডার ফিওডোরোভনার ড্রয়িংরুমটির সোনার স্তম্ভ, স্বর্ণবাতিদান, সোনার পাতের কারুকার্যমণ্ডিত ঝাড়লন্ঠন দেখে তো আমি হতবাক। Treasure Gallery তে রয়েছে স্বর্ণ ও হীরকখোচিত নানাবিধ অলংকার। রয়েছে সোনার ‘Peapock Clock’।
ফ্রান্স, স্পেন,ইতালির নবজাগরণের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী–রাফায়েল, জর্জনে, ভেরোনেজে, পিত্তোনি,টিনটোরেত্তো,টিসিয়ান,ভানডাইক,মুরিল্লো এবং মাইকেল অ্যাঞ্জেলো ও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জগদ্বিখ্যাত চিত্রাবলীর এক অভূতপূর্ব সংগ্রহ সংরক্ষিত আছে এই মিউজিয়ামে। নিউ হার্মিটেজ ভবনে রাফায়েল চিত্রিত–Connestabile Madonna ও Madonna with Beardlrss St.Joseph এবং লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির Madonna Lita ও Benois Madonna ছবিগুলি দেখে মনে হয় এ যেন স্বয়ং ঈশ্বরের সৃষ্টি । এই মিউজিয়ামে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ‘Crouching Boy” নামক একটিমাত্র শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে। Knight Hall টি মূলত 15শ থেকে 17শ শতকের বিভিন্ন অস্ত্র ও মুদ্রার সংগ্রহশালা । এছাড়াও ইজিপ্ট,মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলনের সভ্যতার নিদর্শন রয়েছে একটি বৃহৎ কক্ষে।
হার্মিটেজ মিউজিয়ামে বিখ্যাত কিছু ভাস্কর্য আছে, যার দর্শনে জীবন সার্থক মনে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল— Antonio Canova নির্মিত Kiss of Cupid and Psyche, Orpheus, Mary Magdalen। Griusppe Maxzuola নির্মিত Death of Adonis, Paolo Audrea Triscormiaর Sleeping Ariadua এবং Laocoon and his Sons — মার্বেল পাথরের এবং টেরাকোটার মূর্তিগুলির দেহাবয়বের সুষমা শুধু নয় মুখের ভাবে ফুটে ওঠা মিলনের তৃপ্তি,কখনও বা মৃত্যু যন্ত্রণা অথবা জীবনের প্রশান্তি দেখে গায়ে শিহরণ জাগে। শিল্পীকে স্বয়ং ঈশ্বর বলে মনে হয়।
হার্মিটেজ মিউজিয়াম দেখে মিখাইলোভস্কি প্রাসাদে গড়ে ওঠা স্টেট রাশিয়ান মিউজিয়াম দেখতে গেলাম। এই মিউজিয়ামে যে বিষয়টি মুখ্যত দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল এর চিত্র সংগ্রহ। প্রায় ছ’শোরও বেশি ‘Icon Painting’ রয়েছে এখানে। গ্রীক ‘ eikon’ শব্দের অর্থ image। এটি একধরনের ধর্মীয় শিল্পকর্ম, যাঁর মূল বিষয়বস্তু Christ, Mary,Saints, angles ইত্যাদি। পোট্রেট স্টাইলে অঙ্কিত একটি বা দুটি মূর্তির মাধ্যমে ‘ইস্টার্ন ক্রিস্টানিটি’কে তুলে ধরা হয়েছে। ধাতু,কাপড়,পাথর,বা কাঠের ফলকে এই ধরনের আইকন চিত্রের মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন সম্ভব– এমনই বিশ্বাসের ভূমিজাত এই বিস্ময়কর সৃষ্টি।
1917 বিপ্লবের পর রাশিয়ার বহু মূল্যবান সম্পদ, যেগুলি জাতীয় সম্পদে পরিণত হয় তার অধিকাংশই এই মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। অসাধারণ কিছু ছবি,যেমন– Ivan Aivazovskyর আঁকা ‘ The Ninth Wave, Karl Brullov এর Angel with Golden Hair The Last day of Pompeii , Llya Repin অঙ্কিত What Freedom ‘ ইত্যাদি সামনে দাঁড়িয়ে দেখার সৌভাগ্যের অধিকারীণি আমি একথা ভেবে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় হৃদয় পূর্ণ হয়ে যায় ।
সত্যি বলতে কি আমাদের হাতে সময় ছিল কম, তা না হলে একদিনে রাশিয়ার দুটি বিখ্যাত মিউজিয়াম দেখে হৃদয়ঙ্গম করা খুবই কঠিন কাজ।
মধ্যাহ্ন আহারের পর আমাদের দলের কিছু সদস্যমিলে সিদ্ধান্ত নিলাম সেন্ট পিটার্সবার্গের ক্যানেলগুলিতে নৌকাবিহার করবো। স্থানীয় ট্যুর গাইড জনপ্রতি 15 ডলার খরচে আমাদের এই জলপথ ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিল এবং নিজে আমাদের সঙ্গে থেকে ধারাবিবরণীর সাহায্যে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটির একটা সুন্দর ছবি তুলে ধরলো। বৃহদাকার নৌকাটিতে একদিকে ডেকে বসার ব্যবস্থা, অন্যদিকে একটু নীচে কাঁচের জানালা পরিবৃত কেবিন । আমরা অবশ্য সকলে ডেকেই বসেছিলাম। ক্যানেলের দু-পাশে একে একে দেখলাম সার্কাস হাউজ, পার্লামেন্ট ভবন, সাহিত্যিক চেখভ, আলেকজান্ডার পুশকিন প্রমুখের বাড়ি,নিকোলাস গার্ডেন, দস্তভয়স্কির ‘Crime and Punishment ‘এ উল্লিখিত ধনকুবেরদের প্যালেস, উইন্টার প্যালেস ইত্যাদি । ক্যানেলের উপর নির্মিত এক-একটি সেতুর কাঠের কাজ বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ক্রমে আমাদের নৌকাটি ক্যানেল দিয়ে নেভা নদীতে গিয়ে পড়লো। পূর্ণযৌবনাবতী নেভানদীর উত্তাল তরঙ্গে দোদুল্যমান খেয়ায় দলের অন্যান্য সঙ্গীরা দু-পাশের দৃশ্যাবলি উপভোগ করলেও আমার কিন্তু বেশ হৃৎকম্পন শুরু হয়েগিয়েছিল। ডেকে একটি চেয়ারে স্থির হয়ে বসে নদীর গাঢ় নীলজলরাশির কলোচ্ছ্বাস শুনছি আর গাইড বর্ণিত Zayachy Island, পিটার-পল দূর্গ, Isaac Cathedral প্রভৃতি চোখ মেলে দেখে নিলাম। পাশাপাশি আরোও অনেকগুলি নৌকা আমাদের মতোই জলবিহার করছে। কোনো কোনো নৌকার যাত্রীরা হাত নেড়ে হৈহৈ করে গান গাইতে গাইতে আমাদের অভিবাদন জানালো। কিছু সময় এভাবেই নেভা নদীর বুকে ভেসে থাকতে থাকতে কখন যে ভয় ভেঙে নদীটাকে ভালোবেসে ফেললাম নিজেই বুঝতে পারিনি । চেয়ার ছেড়ে উঠে নদীর ছবি তুললাম। এমনকি নৌকাটি যখন নদী থেকে আবার ক্যানেলে প্রবেশ করলো তখন জানিনা কেন বেশ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।আমার মতো জলভয়ে ভীত মানুষের পক্ষে এ এক অভিনব অনুভূতি!
হোটেলে ফিরে এলাম। সারাদিন ধরে সেন্ট পিটার্সবার্গের সেরা দ্রষ্টব্যগুলো যা দেখা হয়েছিল,তা রাশিয়া ভ্রমণের স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। স্বপ্নাবিষ্টের মতো কেটে গেল রাশিয়ার চারটি দিন। ইতিহাস-রাজনীতির মেলবন্ধনে,সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিচিতি গঠনে, জনজীবনের নিয়মানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতা,শিল্প-সাহিত্য-ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও রক্ষণশীলতায় রাশিয়া অতুলনীয়।
পরদিন অর্থাৎ 8ই জুন সকালে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর আর সুন্দরী নেভা নদীকে বিদায় জানিয়ে আমরা ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কির উদ্দেশ্যে রওনা
হলাম।
রাশিয়া ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: –
1)রাশিয়া ভ্রমণের ভিসা কলকাতার রাশিয়ান দূতাবাস থেকে পাওয়া যায় ।
2)রাশিয়ার মুদ্রার নাম রুবল ( এক ইউরো=65রুবল পরিবর্তনসাপেক্ষ)
3)ভাষার সমস্যা থাকায় স্থানীয় ট্যুর গাইড আবশ্যক ।
4) খাবার জলের মান ভালো না হওয়ায় মিনারেল ওয়াটার কিনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
5) মে-জুন মাসে হালকা ঠান্ডা, মনোরম আবহাওয়া কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে ভালো ঠাণ্ডা থাকে।
6)ছাতা-রোদচশমা অপরিহার্য ।
7)বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির মারফত সাইট সিয়িং, ক্যানেল ক্রুজের ব্যবস্থা করা যায় ।
8)মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গে বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাঁরা যাবেন তারা মস্কোর –সিটি কমফর্ট হোটেল, আরারাত পার্ক হায়াত, ফোর সিজিনস, হোটেল কসমস ইত্যাদি হোটেলে থাকতে পারেন। সেন্ট পিটার্সবার্গে -অ্যাম্বাসাডর, হার্মিটেজ, পার্ক ইন, নেপচুন প্রভৃতি হোটেল ভালো।
9) হাতে সময় থাকলে রাশিয়ার বলশয় ব্যালে, লোকনৃত্য, সার্কাস ইত্যাদির রসাস্বাদনের সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।