Breaking News
Home / TRENDING / রথযাত্রা শুধু জগন্নাথের নয়

রথযাত্রা শুধু জগন্নাথের নয়

 

স্বপনকুমার ঠাকুর   :

মহাধুমধামে শুরু হল রথযাত্রা। জগন্নাথ চলেছেন মাসির বাড়ি। সকলেই জানেন এই রথ— মানে একালের প্রাইভেট কার বা রিকশার মতো সেকালের নিছক এক যানবাহন। তবে সূত্রধর বা ছুতোরদের হাতে পড়ে হত অপূর্ব এক সৃষ্টি! কাঠের হলে কী হবে, ওরই মধ্যে থাকে কয়েকটা কুঠুরি। চিত্রিত গবাক্ষ। দৃষ্টিনন্দন চূড়া। নানা বিভঙ্গের দারুমূর্তি, রংবাহারি অলংকরণ। আর বড় বড় চাকা। আগে রথ টানত ঘোড়ায়। আর এই দেবযানটিকে টানেন ভক্তজন।
বৈদিক সাহিত্য থেকে শুরু করে মহাকাব্য, পুরাণেও রয়েছে রথকথা। রথ শুধু পরিবহণের মাধ্যম নয়, ছিল যুদ্ধযানও। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের আর্তনাদ ঢেকে যেত হাজার হাজার রথের চাকার আওয়াজে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে স্বয়ং কৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের রথের সারথি। জলপথে চলত কিনা জানা নেই, তবে রথ আকাশে উড়ান দিত। রাবণ সীতাকে হরণ করেই পাড়ি জমিয়েছিলেন মহাকাশে। মঙ্গলকাব্যের নায়ক-নায়িকারা হলেন স্বর্গভ্রষ্ট দেবদেবী। নির্ধারিত দেবতার মর্তে পুজোর প্রচার করে পুনরায় স্বর্গে ফিরে যেতেন রথে চেপে। রাজপথ মানেই রথ চলার প্রশস্ত পথ। তার থেকেই উদ্ভব বাড়ির সদর দরজা ‘নাছদুয়ার’। নাছ শব্দটি এসেছে রথ্যা থেকে। রথ্যা মানে রাজপথের ওপর রথ চলাচলের প্রশস্ত দরজা। সুতরাং রথ নিয়ে যে সাধারণ মানুষ মাতামাতি করবেন তাতে সন্দেহ কী!
আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। ভগবান বিষ্ণুর অবতার জগন্নাথ দাদা বলভদ্র বোন সুভদ্রাকে নিয়ে তিনি মাসির বাড়ির গমন করেন। এক সপ্তাহ থাকার পর ফিরে আসেন উল্টোরথে। পুরীর রথযাত্রা উৎসব শুধু ভারত নয়, সারা দুনিয়ার কাছে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গেও কম জনপ্রিয় নয় রথযাত্রা উৎসব। মাহেশ, মহিষাদল, গুপ্তিপাড়া কিংবা দিগনগরে রথের রশির টানে মেতে ওঠেন আট থেকে আশি। রথের মেলা একবেলাতেই বৃষ্টিভেজা আষাঢ়ের বাতাসে পাপড় ভাজার গন্ধ বলে দেয় আজ রথযাত্রা।
তবে রথযাত্রা শুধু জগন্নাথেরই নয়, অন্যান্য দেবতাও রথে চেপে নগর পরিক্রমা করেন। দক্ষিণ ভারতে পৌষমাসের শুক্লা তিথিতে নটরাজের রথযাত্রা সাড়ম্বরে পালিত হয়। চৈত্রমাসের একাদশীতে অনুষ্ঠিত হয় ওডিশার ভুবনেশ্বরের রথযাত্রা। রাঢ় অঞ্চলের অনেক গ্রামে রথে চেপে মুক্তস্নানে বের হন ধর্মরাজ। বর্ধমানের ভাতার থানার এড়ুয়ার গ্রামে শ্রাবণমাসের সোনার কালী পুজোয় দেবী গ্রাম পরিক্রমা করেন ঐতিহ্যবাহী পিতলের রথে। কলিগ্রামে আবার জয়দুর্গা পুজোর পরদিন দেবী আর তাঁর মানুষ-বর একসঙ্গে রথে চেপে গ্রাম পরিক্রমা করেন। ঢাক আর বর্নাঢ্য শোভাযাত্রার সঙ্গে। চিনা পরিব্রাজক ফা হিয়েনের লেখা থেকে জানা যায় খ্রিষ্টীয় পাঁচ শতকে বুদ্ধদেবের রথযাত্রা নগর পরিক্রমা করত। বড় রথে বুদ্ধের মূর্তি বসিয়ে বিশাল শোভাযাত্রা বের হত। অনেকেই বলেন জগন্নাথের রথযাত্রা নকল করা হয়েছে বৌদ্ধ রথযাত্রা থেকেই। কেউ কেউ বলেছেন। বৌদ্ধ ত্রিরত্নই জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা।
রথযাত্রার উৎস নিয়ে বিতর্ক থাকলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের দেববিগ্রহ ও দেবায়তন নির্মাণে রথের প্রভাব পড়েছে বিস্তর। পাথরের তৈরি বিগ্রহের পাদপীঠগুলি ত্রি-পঞ্চ রথাকৃতি হয়ে থাকে। এটি একটি জনপ্রিয় আঙ্গিক। অন্যদিকে বাংলার দেউল বা রত্নমন্দিরগুলি রথের সাদৃশ্যে গড়ে উঠেছে। রথের চূড়ার মতো এই মন্দিরের চূড়ার সংখ্যা এক থেকে পঁচিশ পর্যন্ত দেখা যায়। রথযাত্রা শারদোৎসবেরও সূচনা করে প্রতিমার গায়ে মাটি দিয়ে। এদিন থেকে শুরু হয় দুর্গা পুজোর কাউন্টডাউন। এখনও রথযাত্রার দিন চিৎপুরের যাত্রা দলগুলি তাদের নতুন পালার বিজ্ঞাপন দেন এবং বায়না নিতে শুরু করেন। শুরু হয় চিৎপুরে তৎপরতা।

Spread the love

Check Also

চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক

ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …

আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ

জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …

নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই

সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *