রাজনীতির কুরুক্ষেত্রে অসহায় কংগ্রেস
সুমন ভট্টাচার্য :
(অভিজ্ঞ সাংবাদিকের কলমে এবার থেকে ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যাবে জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি)
দিল্লিটা আসলে আরাবল্লী পর্বতের ‘এক্সটেনশন’। এটা আমার ছোটবেলা থেকে ধারণা। সেইজন্যেই রাজধানীর আবহাওয়াটাও এইরকম ‘এক্সট্রিম’। গরমে দুর্দান্ত গরম। শীতে কনকনে ঠান্ডা। আর দিল্লির জলবায়ু-র মতোই রাজধানীর রাজনৈতিক আবহাওয়া। সেই রাজনৈতিক আবহাওয়ায় যখন যাঁর দাপট চলে, তখন তাঁদেরই ‘রাজ’ চলে। অন্যপক্ষকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়।
এখন যেমন দিল্লিতে গেরুয়া শিবিরের ‘রাজ’। নরেন্দ্র মোদীর দাপটে দিল্লিতে অন্য দলগুলিকে খুঁজতে মাইক্রোস্কোপ লাগছে! রোজই কংগ্রেসের ঘর ভাঙছে, কোনও-না-কোনও রাজ্য থেকে বিপর্যয়ের খবর আসছে। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের হেভিওয়েট নেতারা পড়েছেন বিপদে। এমনিতে কংগ্রেসের বড় নেতাদের গরমের দিল্লিতে থাকার অভ্যাস নেই। ইউপিএ সরকারের ১০ বছরে গরম পড়া মাত্র এরা অধিকাংশই ইওরোপের শীতপ্রধান দেশগুলোতে ‘টুর’ নিয়ে বেরিয়ে যেতেন! লন্ডন, বার্লিন, প্যারিস তো বটেই, এমনকী বুদাপেস্ট বা হেলসিঙ্কিতেও সেইসময় ভারত সরকারের প্রতিনিধি দল পাঠানোর হিড়িক থাকত। কিন্তু সেই ইউপিএ আর নেই, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আর নেই! আমি এমনটা বলছি না, কংগ্রেসের হেভিওয়েট নেতারাও সরকারি খরচ ছাড়া নিজেদের পকেটের পয়সায় ইওরোপে গরমের ছুটি কাটাতে যেতে পারেন না! জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, কমল নাথ, কপিল সিবাল-রা অবশ্যই পারেন। কিন্তু দলের এই ঘোর দুর্দিনে, যখন একের পর এক রাজ্য থেকে নির্বাচনী বিপর্যয়ের সংবাদ আসছে, তখন প্যারিসে গিয়ে সেলফি তোলাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়! যার উপরে ১০ নম্বর জনপথবাসিনী এখন কংগ্রেসের সংগঠন ঢেলে গোছাতে চলেছেন বলে খবর। সনিয়া গান্ধির ‘টিম’-এর বদলে এখন নাকি রাহুল গান্ধির পারিষদবর্গ দায়িত্ব নেবেন বলে দিল্লির রাজনৈতিক মহলে গুজব। সবাই উৎকণ্ঠায় নিজের নিজের ‘স্মার্টফোন’ হাতে ধরে বসে আছেন। কখন ‘যুবরাজ’ রাহুল গান্ধির ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ মেসেজ বা ‘বি বি এম’ এসে ঢোকে। ‘আপনার নতুন দায়িত্ব…’ অথবা ‘আপনাকে পুরনো দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হল….’ ইত্যাদি। নরেন্দ্র মোদী তো লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী মনোহর জোশীদের ‘মার্গদর্শক মণ্ডলী’তে পাঠিয়ে দিয়ে দলের কতৃত্ব অমিত শাহ, শিবপ্রকাশদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এবার রাহুল গান্ধিও ওইরকম ‘মার্গদর্শক মণ্ডলী’-র মতো কিছু বানিয়ে দিগ্বীজয় সিংহ, আহমেদ প্যাটেলদের ‘রাজনৈতিক অবসর’-এ পাঠিয়ে দেন কিনা, সেই অপেক্ষায় সকলে। অতএব এইরকম একটা পরিস্থিতিতে তো বিদেশে ছুটি কাটাতে যেতে যাওয়া যায় না!
তার ওপরে কংগ্রেস নেতাদের আবার নতুন বিপদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সনিয়া গান্ধি চেষ্টা করছেন বিরোধীদের সবাইকে একজোট করে নরেন্দ্র মোদীর মোকাবিলা করার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কথা বলেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে। শরদ পাওয়ারের সঙ্গে একদফা বৈঠক হয়েছে। কংগ্রেস সভানেত্রী এক এক জন বিরোধী দলের ‘সুপ্রিমো’-র সঙ্গে কথা বলছেন আর কংগ্রেস নেতাদের দায়িত্ব বাড়ছে। রাজনৈতিক জল মাপতে নেমে পড়তে হচ্ছে। কথা বলতে হচ্ছে বিরোধী দলের মেজো-সেজো নেতাদের সঙ্গে। দিল্লির এই গরমে এতখানি কষ্ট করা কংগ্রেস নেতাদের গত এক দশকের অভ্যাসে ছিল না। দিল্লি থেকে কুরুক্ষেত্রের দূরত্ব বেশি নয়। কিন্তু রাজনীতির এই কুরুক্ষেত্রে বড়োই অসহায় দেখাচ্ছে কংগ্রেসকে।