চিরজিত পাল :
১৮ই অগাস্ট ১৯৪৫-এর দুপুর ২.৩০ নাগাদ যে-জাপানি যুদ্ধবিমান তাইহোকু (বর্তমান তাইওয়ান) বিমানবন্দরে ভেঙে পড়েছিল, এবং যাতে নেতাজি-র যাত্রা করার কথাও ছিল, তাতে তার মৃত্যু হয়েছে কিনা সেই প্রশ্নের নিষ্পত্তি আজও হল না, হয়তো কোনওদিন হবেও না। কোনওদিনও না হতে পারে বলতে হচ্ছে (তা সেটা শুনতে যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন) তার কারণ যত বেশি সময় অবিবাহিত হবে সত্য উদ্ঘাটন ততই দুরূহ হয়ে উঠবে। আর সেটাই যদি নেহরু বা কংগ্রেসের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাতে তারা যথেষ্ট সফল বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। এমনিতেই প্রত্যক্ষদর্শীরা আজ আর কেউ নেই। তাই নতুন করেও যদি কোনও তদন্ত হয় সেটা সার্কামস্টেন্সিয়াল এভিডেন্স-এর ওপরেই ভিত্তিতেই করতে হবে। যদি আমরা ধরে নিই যে-সমস্ত সার্কামস্টেন্সিয়াল এভিডেন্স অতীতেই বিকৃত করা হয়েছে তদন্তকে ফলপ্রসূ না হতে দেওয়ার জন্যে, তাহলে ভবিষ্যতে সেটা সেই অবস্থাতেই থাকবে। নতুনভাবে সত্যটা উঠে আসার কোনও সম্ভাবনাই তাই আর নেই যদি-না রাশিয়া, ব্রিটেন, বা জাপান তাদের গোপন ফাইল-এ নথিভুক্ত তথ্য (যদি সেরকম কিছু সত্যিই থেকে থাকে) প্রকাশ্যে আনে। প্রথমত সেরকম কিছু আছে কিনা সেটা কারওর নির্দিষ্ট করে জানা নেই, সবাই অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলছেন। থাকলেও তারা কেন তা এতো বছর বাদে প্রকাশ করতে চাইবেন? যদি সত্যিই তাতে স্তালিন বা চার্চিল বা এটলির কোনও ষড়যন্ত্রের উল্লেখ থাকে, সেটা তাঁরা ঢাক পিটিয়ে প্রকাশ করতে যাবে কোন দুঃখে? কোন দেশ-ই চাইবে অতীতের কলঙ্ক খুঁড়ে বার করতে? চাইতে পারতো যদি ভারত সরকার বিশ্বদরবারে প্রভূত প্রচুর ক্ষমতাশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি দিত। সেই হুমকিতে ভয় পেয়ে ওই সব দেশ সুড়সুড় করে ফাইলগুলো বার করে দিতে পারত। দুঃখের ব্যাপার যে ভারত এখনও সেই জায়গায় পৌঁছতে পারেনি, আর সরকারও এই বিষয়টাকে এতো গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। কারণ সরকারকে আবেগে চলে না, তাকে বাস্তববাদী হয়ে হয়। অতীত খুঁড়তে গিয়ে বর্তমান বা ভবিষ্যৎকে তালগোল পাকিয়ে দেওয়ার মতো মূর্খামি তাদের মানায় না।
এটা মোদী সরকারের নেতাজির প্রতি অবহেলা ভাবলে ভুল হবে। ওরা কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু রহস্য নিয়েও মাথাখারাপ করছে না। কংগ্রেসকে জব্দ করার জন্যে তারা মাঝেমধ্যে নেতাজি নিয়ে একটু খোঁচাখুঁচি করে বটে তবে কংগ্রেসকে আর নতুন করে জব্দ করার কোনও প্রয়োজন নেই।
এবার একটু আসি রাজনীতির কোথায়। বাঙালির আবেগকে রাজনীতিতে কাজে লাগাতে পারলে সবার-ই বেশ লাভ। বাঙালি এমনিতেই রোম্যান্টিক জাতি, নেতাজির মতো একজন বীরকে অমর দেখতে চাওয়ার একটা অদম্য বাসনা তার আছে, কিন্তু কালের নিয়মেই তা আর সম্ভব নয়। তাই নিদেনপক্ষে একটা কন্সপিরেসি থিয়োরি নিয়ে থাকা। সেটা সাধারণ মানুষ-এর জন্যে ঠিক আছে। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক দল এই সুযোগ-এ নিজেদের বেশি বাঙালি, বেশি জাতীয়দাবাদী প্রমাণ করতে গেলেই মুশকিল হয়। নেতাজির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্যে গান্ধী এবং নেহরুকে দায়ি করব, কিন্তু উঠতে বসতে তাদের বংশধরদের সাথে চা খাব, জোট করব, সেটা একটা সুবিধেবাদী পথ ছাড়া কিছু নয়? দরদটা যদি এতটাই বেশি হয় তাহলে আরও একটু সততার প্রয়োজন আছে। জনগণ সেটা বুঝলে ভাল, দাবি করলে আরও ভাল।
এখন এতো কথা আলোচনা হচ্ছে কেন? কারণ সম্প্রীতি ভারত সরকার একটা RTI -এর উত্তরে জানিয়েছে যে নেতাজি-র মৃত্যু ওই দিনকে ওই ভাবেই হয়েছিল। এটা নিয়ে আমরা প্রচুর প্রতিবাদ করছি, ভাল কথা , কিন্তু সরকার কি এর বাইরে কিছু করতে পারতো? সরকার-কে দস্তাবেজ-এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত জানাতে হয়, আবেগের বশে নয়। সরকারের তিনটে কমিশনের মধ্যে দুটি – শাহনাওয়াজ এবং খোসলা কমিশন ১৯৪৫-এ নেতাজির মৃত্যুর পক্ষেই রায় দিয়েছিল। বাজপেয়ী গঠিত মুখার্জী কমিশন নেতাজির মৃত্যু ১৯৪৫এ হয়নি বলে রিপোর্ট দিয়েছিলো, কিন্তু সেই রিপোর্ট ২০০৬ সালে UPA সরকার খারিজ করে দেয়। তাই হাতে রইল যে দুটো তার ভিত্তিতে এর বাইরে সরকারের কিছু বলার থাকতে পারে না। হ্যাঁ, যেটা পারে সেটা হলে আরও একটা তদন্ত কমিশন গঠন করা। সরকার জানিয়েছে যে উপযুক্ত নতুন প্রমাণ সামনে এলে সেটা করা যেতে পারে। অনুমান নয়, কিছু নতুন প্রমাণ সামনে আসুক, এই আশাতেই আমরা আপাতত বুক বাঁধি।