তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় :
(প্রাক্তন আমলা, উত্তরপ্রদেশ)
আমরা সবাই জানি, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রাজনৈতিকভাবে মুক্তি পেয়েছি, কিন্তু আমরা অর্থাৎ ভারতীয়রা কি ক্রীতদাসত্বের সমস্ত শৃঙ্খল খুলে ফেলতে পেরেছি? উত্তরটা জোর গলায় বললে হবে, ‘না, কারণ, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা এখনও ‘আক্ষরিক অর্থেই সারা বিশ্বের ইওরোপকেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক মডেলকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে: এটা শুধুমাত্র কোনও একটা নির্দিষ্ট বিশ্বাসের কথা নয়, এটা হল একগুচ্ছ বিশ্বাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা একটা সুগঠিত নিখুঁত মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে, বা বলা যায়, তা একটা সুবিন্যস্ত পূর্ণতা পেয়েছে, এমনই একটি তত্ত্ব: যা বিভিন্ন সাধারণ ঐতিহাসিক, ভৌগৌলিক, সামাজিক এবং দার্শনিক ক্ষুদ্র তত্ত্বের কাঠামো হিসাবে কাজ করা একটি মহতী তত্ত্ব’– জে এম ব্লাউট। ব্রিটিশদের হাতে ভারতীয়দের নিপীড়ণের উপকরণই হল এ দেশের ইতিহাস। “যে রাষ্ট্র নিজের দেশের ইতিহাস নিজেরাই বিকৃত, উপেক্ষিত করার অনুমতি দেয়, বা ইতিহাসের শিক্ষার ওপর মিথ্যার প্রলেপ দেয় সে রাষ্ট্রের অধোগামিতা রোধ করা অসম্ভব”– শ্রীকান্ত তলাগিরি (দ্য এরিয়ান ইনভেশন থিয়োরি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশন্যালিজম গ্রন্থের লেখক)
যবে থেকে বাম বৌদ্ধিকতা ব্যাপ্ত হল তখন থেকে ‘ভারতীয় ইতিহাস আজ যে রূপ পরিগ্রহ করেছে, যেভাবে তা পড়ানো হয় এবং প্রচারিত হয় তা বাম ‘বুদ্ধিজীবী’দের মস্তিষ্কসৃষ্ট। এবং যেহেতু বামপন্থী আদর্শের একটি প্রাথমিক লক্ষ্য হল, জাতীয় সত্তাকে ধ্বংস করা, এটা খুব একটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, ভারতের জাতীয় সত্তা এবং ঐতিহ্যকে ছিন্নমূল এবং ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে, পাঠ্যক্রমের বিষয় হিসাবে আমাদের ইতিহাসকে ভীষণভাবে বিকৃত করা হয়েছে’—শ্রীকান্ত তলাগিরি
কিন্তু কেন এমন হল? কারণ, ভারত এবং আমাদের অতীত সম্পর্কে ওদের (মার্ক্সবাদী এবং তাদের সহযাত্রী– ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের) প্রতীতি সেইসব পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে যাঁরা কোনওদিন ভারতে পদার্পণ করেননি, কোনও ভারতীয়ের সঙ্গে দেখা করেননি, কোনও ভারতীয়ের সঙ্গে কথা বলেননি, ভারতীয় সাহিত্যের সঙ্গে যাঁদের কোনও পরিচয় ঘটেনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এইসব চিন্তাবিদ, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং আমলারাই ভারত সম্পর্কে লিখেছেন, এবং তাঁদের লেখা থেকেই ভারতীয় বুদ্ধজীবীরা প্রভাবিত হয়েছেন। এমনই একজন বিখ্যাত দার্শনিক এবং অর্থনীতিবিদ হচ্ছেন কার্ল মার্ক্স, যাঁকে ‘কমরেড’রা বিপ্লবী বলে চিহ্নিত করেন। তাঁর লেখা এ দেশের বহু ইতিহাসবিদ, রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবীকে প্রভাবিত করেছে, যদিও তাঁর ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে কোনও অভিজ্ঞান বা উপলব্ধি ছিল না। নিউইয়র্ক ট্রিবিউনে ১৮৫৩ সালের ২৫ জুন তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন, আর একটি লেখেন ১৮৫৩ সালের ২২ জুলাই, সেগুলি থেকেই তাঁর বোধ সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। তিনি লিখছেন, ‘‘যেমন ইতালিতে, বিভিন্ন সময়ে বিজেতাদের তরবারি ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তাবাদ প্রোথিত করেছে, তেমনই একই ঘটনা ঘটতে দেখেছি হিন্দুস্তানে, যখন তা মুসলিম, বা মোগল বা ব্রিটিশ শাসনের অধিকারে নেই তখনই তা বিভিন্ন স্বাধীন এবং পরস্পরের সঙ্গে কলহে মত্ত বহু রাজ্য, বহু শহর এমনকী গ্রামের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছে।“ তিনি একথাও বলেছেন, ‘‘যাঁরা হিন্দুস্তানের স্বর্ণযুগের কথা বলেন, আমি তাঁদের অভিমতের সঙ্গে একমত নই।“ এই কারণেই তিনি ভারতে হানা দিতে এসে ম্যাসিডনের আলেকজান্ডারের ব্যর্থতার কথা লিপিবদ্ধ করেনননি, আর রাজাধিরাজ ভারতীয় সম্রাট ‘বিক্রমাদিত্য’র কথা তো বাদই যাক, তিনি মৌর্য বা গুপ্ত সাম্রাজ্যের কথাও নস্যাৎ করে দিয়ে, এমন এক ভাবধারার জন্ম দিয়েছেন যা ভারতের স্বর্ণযুগকেই অস্বীকার করে।“ তিনি বলেছেন, “ভারতীয় সমাজের কোনও ইতিহাসই নেই, অন্তত সেরকম কিছু জানা যায় না। আমরা যেটাকে ইতিহাস বলে অভিহিত করে থাকি সেটা হল, ক্রমান্বয়ে ভারতে আছড়ে পড়া বিভিন্ন বিদেশি হানাদারদের ইতিহাস, যারা একটা অপ্রতিরোধী এবং অপরিবর্তনীয় সমাজের নিষ্ক্রিয়তাকে পুঁজি করে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে।“ এই চিন্তাধারাই তিনি ভারতীয় মার্ক্সবাদীদের মধ্যে চারিয়ে দিয়েছেন, এই চিন্তাধারাই জন্ম দিয়েছে ভারতে আর্যদের ভারত আক্রমণের পৌরাণিক তত্ত্ব। সেখানেই তিনি থামেননি। তিনি বলেছেন, ‘‘এরপর বিজিত হওয়া ব্যতিরেকে ভারতের ভাগ্যের লিখন অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল না আর তার অতীতের সব ইতিহাস, যদি কিছু থেকে থাকে, তা হল ক্রমাগত বহিরাক্রমণে সে যেভাবে বিজিত হয়েছে তার ইতিহাস।“ এরপর যোগ করেছেন, ‘‘এরকম এক দেশ এবং এরকম এক সমাজ কি বিজেতাদের কাছে এক পূর্বনির্ধারিত লুণ্ঠনের বস্তু বলে বিবেচিত হবে না?’’ এরপর তাঁর বক্তব্য, ‘‘এইজন্য এ প্রশ্ন ওঠার কথা নয় যে ব্রিটিশদের ভারত বিজয়ের অধিকার আছে কিনা, প্রশ্নটা হল, ব্রিটিশদের ভারত বিজয়ের চেয়ে তুরস্ক, পারস্য বা রাশিয়ার ভারত অভিযান আমাদের কাছে অধিকতর কাম্য কিনা।“ এভাবেই তিনি ভারতবাসীর মধ্যে হীনম্মন্যতার বীজ রোপন করে দিয়েছিলেন, এবং তা পুষ্ট করেছিলেন ‘অনিবার্যতা’ (ভাগ্যনির্দিষ্ট নিশ্চয়তা) এবং তাঁর ‘বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে’র ভিত্তিতে যে তত্ত্বে প্রোলেতারিয়েতের বিজয়, রাষ্ট্র ও সেইসঙ্গে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের আধিপত্যের বিনষ্টির কথা বলা হয়েছে (পুলকিত মিশ্র- OPINDIA.COM)। যখন পাশ্চাত্য সামাজ্যবাদের ফাঁসে হিন্দুরা হাঁসফাঁস করছে এবং ভারতে মুসলিম শাসনের স্মৃতি যখন রীতিমতো তাজা, তখনই আর্যদের ভারত অভিযানের কথা পাশ্চাত্য বিদ্দজ্জ্বনেরা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। ডা. ভীমরাও অম্বেদকর নিজে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঋগ্বেদ এবং অভেস্তা পাঠ করেছিলেন। পশ্চাদপট বিবেচনা করে তিনি কিছু শব্দের, যেমন আর্য, দাস, দস্যু, মৃদর্ভক, অনস, কৃষ্ণনয়নী, বর্ণ ইত্যাদির পৌনঃপুনিক ব্যবহারের সংখ্যা গণনা করেছিলেন, যে শব্দগুলি বহিরাক্রমণের সমর্থকেরা (তাত্ত্বিক), নিজেদের অভিমত প্রতিষ্ঠার জন্য সুবিশাল গ্রন্থ (যেমন ঋগ্বেদ) থেকে চয়ন করেছেন। এরপর তিনি বলেন, ‘‘ঋগ্বেদে অন্তত এমন বিন্দুমাত্র কোনও প্রমাণ নেই যা সাক্ষ্য দেয়, আর্যরা বাইরে থেকে এসে ভারত আক্রমণ করেছিলেন…আর্যদের বাসভূমি ছিল ভারতের বাইরে এমন কোনও তত্ত্ব বৈদিক সাহিত্য বহন করছে না (সূত্র: ১৯৪৬ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘হু ওয়্যার দ্য শুদ্রস’ এবং ১৯৯০ সালে মহারাষ্ট্র সরকার প্রকাশিত তাঁর ‘স্পিচেস অ্যান্ড রাইটিংস’ সংখ্যা ৭, পৃষ্ঠা ৭৪-তে পুনর্মুদ্রিত)।
বেদ-এ লিখিত বর্ণ শব্দের অর্থ পণ্ডিতরা যে মনে করতেন ত্বক, তা তিনি খারিজ করেছিলেন-২২ টি ক্ষেত্রে তা গায়ের রং হিসাবেই বর্ণিত হয়েছে, (আইবিড-পৃষ্ঠা-৮২) উপসংহারে তাঁর বক্তব্য:-
১) বেদ-এ আর্য বলে কোনও জাতির পরিচয় নেই ।
২) বেদ-এ এমন কোনও প্রমাণ নেই যা থেকে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় যে দাস বা দস্যু, অর্থাৎ যাদের এদেশের আদিবাসী বলে ধরা হত, তাদের ওপর আর্যরা অভিযান চালিয়েছিল।
৩) আর্য, দাস এবং দস্যুর মধ্যে যে পার্থক্য ছিল, তা জাতিগত বিভাজনের সাক্ষ্য দেয় না ।
৪) আর্যদের গাত্রবর্ণ দাস বা দস্যু থেকে পৃথক ছিল, এমন কোনও বক্তব্যের সমর্থন বেদ থেকে মেলে না (আইবিড পৃষ্ঠা ৮৫)(সূত্র: opindia.com, শ্রীকান্ত তলাগিরির এরিয়ান ইনভেশন থিয়োরি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশন্যালিজম এবং রাজীব মালহোত্রর অ্যাকাডেমিক হিন্দুফোবিয়া)।