ঝড়ের ঠিকানা – (পর্ব – ৮)
সঞ্জয় সিংহ :
(জনপ্রিয় এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক সঞ্জয় সিংহের স্মৃতিসরণিতে অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় )
লালু আলমের লাঠির ঘায়ে মাথা ফেটেছে। হাত ভেঙেছে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেইসময় একদিন মমতা শুনলেন, রাজীব গান্ধী তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ যুব কংগ্রেস সভানেত্রী করেছেন।
পরে মমতাদি গল্প করতে করতে বলেছিলেন, তাঁকে রাজ্য যুব কংগ্রেসের দায়িত্বভার দেওয়া নিয়ে আপত্তি ছিল সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি রমেশ চেনিথাল্লার তো বটেই, তাঁর সঙ্গে বাংলার কয়েকজন শীর্ষ কংগ্রেস নেতারও। কিন্তু ১৯৯০ সালের ১৬ অগস্ট হাজরা মোড়ে মমতার ওপর লালু আলমদের আক্রমণের ঘটনা এবং সিপিএমের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াকু ভাবমূর্তি রাজীব গান্ধী খুবই পছন্দ করতেন। তাঁকে যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভানেত্রীর পদ দেওয়া নিয়ে চেনিথাল্লারা যখন টালবাহানা করছেন তখন রাজীবই উদ্যোগ নেন। মমতাদির মুখ থেকেই শোনা, চেনিথাল্লা একদিন রাজীবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। রাজীব তাঁকে সটান বলেছিলেন, “যাও, যাও আগে গিয়ে মমতার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা তৈরি কর।”
মমতা তো যুব কংগেস সভানেত্রী হলেন। এতদিনে মমতা উপলব্ধি করেছেন, মূল কংগ্রেস বা যুব কংগ্রেসের নেতৃত্বের সিংহভাগই সিপিএমের বিরুদ্ধে কড়া ধাঁচের আন্দোলনের পক্ষপাতী নন। কেন তিনি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করলেন তা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মমতা বার বার বলেছেন, আন্দোলন ছাড়া যে রাস্তা নেই তা কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই বুঝতে চাইতেন না। তাঁরা এই বেশ ভাল আছি মনোভাব নিয়ে চলতেন।
রাজীবজি তাঁকে রাজ্য যুব কংগ্রেসের দায়িত্ব দিতেই মমতা যেন আরও চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায় সোমেন মিত্রদের মতো নেতাদের তোয়াক্কা না করে একের-পর-এক আন্দোলনের কর্মসূচি নিতে লাগলেন। যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী হয়েই তিনি রাজ্য জুড়ে জেলায় জেলায় সিপিএমের গুণ্ডামি, অন্যায়ের প্রতিবাদ থামাতে আইন অমান্যের ডাক দিলেন। মাস তিনেকের মধ্যে বামশাসিত পুরসভা অভিযানের কর্মসূচি নিলেন। তার সঙ্গে মহিলাদের ওপর অত্যাচার, পুলিশের জুলুমের প্রতিবাদে আন্দোলন তো আছেই।
প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের কার্যত উপেক্ষা করে একের-পর-এক আন্দোলনের ডাক দেওয়ায় বাংলার কংগ্রেস কর্মী সমর্থকদের কাছে মমতা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
ফলে, কংগ্রেসের আন্দরমহলে মমতা-বিরোধী গোষ্ঠী রাজনীতিও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু রাজীব গান্ধীর আর্শীবাদের হাত মাথায় থাকায় মমতাকে প্রকাশ্যে খোঁচাতে দলের কেউ বিশেষ সাহস পান না।
এভাবেই সব চলছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের ২১ মে সব কিছুই এলোমেলো করে দিল। শ্রীপেরমপুদুরে রাজীব গান্ধী খুন হলেন। খুবই ভেঙে পড়েছিলেন মমতাদি। সাংবাদিকদের সামনেই তিনি ছিলেন, “বাবার মৃত্যুর পর আমি দ্বিতীয়বার অভিভাবকহীন হলাম।”
কথাটা আক্ষরিক অর্থে সত্যি। রাজীব গান্ধীর আর্শীবাদের হাত মাথায় ছিল বলেই ষড়যন্ত্র করেও কেউ মমতাদির যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভানেত্রী হওয়া আটকাতে পারেনি। ১৯৯১ সালের ভোটে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে মমতাদি পিভি নরসিংহ রাও মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। দিল্লিতে মন্ত্রী হওয়ায় রাজ্য কংগ্রেসে তাঁর গুরুত্ব ত্রমশ বাড়ছিল। বস্তুত, তাঁকে ঘিরেই সমেন-প্রিয়-সুব্রতর বিরোধী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।
কংগ্রেসে গোষ্ঠী রাজনীতি নতুন কথা নয়। মহাত্মা গান্ধী বনাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বিরোধ কোন পর্যায়ে গিয়েছিল তা ভারতের অনেক মানুষই জানেন। কিন্তু ১৯৯২ সালে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের গোষ্ঠী রাজনীতি প্রকাশ্যে এসে গেল। ১৯৯২ সালের ৮ এপ্রিল দক্ষিণ কলকাতার মহারাষ্ট্র নিবাস হলে সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তুলকালাম হয়। কারণ সেই ভোটে সভাপতি পদে সোমেন মিত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি অবশ্য প্রথমে দাঁড়াতে চাননি। দলের ঘরোয়া রাজনীতির আবর্তে পড়ে মমতাদিকে দাঁড়াতে হয়েছিল। নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীনই মমতাদি বুঝেছিলেন তিনি অভিমন্যূ-র মতো চক্রব্যূহে ঢুকে পড়েছেন। জয় অসম্ভব! তাঁর অভিযোগ ছিল, সোমেন-গোষ্ঠীর লোকজনই নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রন করছেন। চমকের আরও বাকি ছিল। ভোটের দিন সোমেন মিত্রের পক্ষে প্রদেশ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের একটা বড় অংশ যখন তাঁদের ‘ক্ষমতা’ বলে ভোট জোগাড় করছেন, তখন হাজরা রোডের ওপর মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তৎকালীন বার্তা সোমেন ঘনিষ্ট ওমর তাঁর বাহিনীর ‘বাহুবলে’ মমতার কর্মী সমর্থকদের এলাকাছাড়া করার কাজে নেমেছিলেন। মমতা হেরে গেলেন সেই ভোটে। তাঁর অভিযোগ ছিল, নিরপেক্ষা ভোট হয়নি। তিনি তো আগেই বুঝেছিলেন, হেরে যাবেন। তবে সরে দাঁড়ালেন না কেন? মমতাদি বলেছিলেন, “সরে গেল, বুঝতে পারতাম না কারা আমাকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিল।”
অবশ্য কংগ্রেসের এক অভিজ্ঞ নেতা বলেছিলেন, “মমতা ভোট থেকে সরে গেল দলীয় রাজনীতিতে গুরুত্বহীন হয়ে যেত।”
সভাপতির পদের জন্য ভোটে হেরে মমতাদি দলীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব কিছুটা হারিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু দলীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে সংসদীয় ভোটের রাজনীতিতে হেরে গুঁটিয়ে যাওয়ার মানুষ তিনি নন। ১৯৮৯ সালে সিপিএমের মালিনী ভট্টাচার্যের কাছে হেরে যাওয়ার পর যে-ভাবে দলের ভিতরে ও বাইরের রাজনৈতিক জাগতে তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
রাজ্য-রাজনীতিতে, বিশেষত, কংগ্রেসের অন্দরে নিজের পায়ের তলার ভিত শক্ত করতে মমতাদি সেই সময় আবার একটা বড় ঝুঁকি নিলেন। ব্রিগেড বামফ্রন্টের ‘মৃত্যু ঘন্টা’ বাজানোর কর্মসূচি। সেই ব্রিগেড সমাবেশে কী হয়েছিল তা শোনাব আগামীবার।