Breaking News
Home / TRENDING / জিএসটি বোলে তো…

জিএসটি বোলে তো…

চিরজিত পাল        :

যে কোনও বিষয় নিয়েই আজকাল চুটকি তৈরি হয়ে যায় !

এই রকম-ই একটা চুটকি চোখে পড়লো কিছুদিন আগে। জিএসটি দুর্বোধ্য বিষয়গুলির মধ্যে তিন নম্বরে এসেছে। এক এবং দু-এ আছে যথাক্রমে স্ত্রী-এর মন এবং ডাকওয়ার্থ লুইসের ক্রিকেটীয় ফর্মুলা। যে বিষয়টা আমরা চার্টার্ড আ্যাকাউনটেন্সি পড়ার সময় ১০০ নম্বর-এর পরীক্ষা দিয়েও পুরোটা আয়ত্ত করতে পারিনি, সেই বিষয়টা অনেকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকবে এতে আর আশ্চর্য কী ! আমি একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করছি, তাতে যদি কিছুটা বিভ্রান্তি দূর করা যায়!

ভারতবর্ষে দু রকম-এর কর ব্যবস্তা আছে – ডাইরেক্ট ট্যাক্স এবং ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স। ডাইরেক্ট ট্যাক্স-এর মধ্যে পড়ে ইনকাম ট্যাক্স (আয়ের ওপর যে কর দিতে হয়) এবং ২০১৫-র বাজেট-এ অবলুপ্ত ওয়েলথ ট্যাক্স (সম্পত্তি কর)। ইনকাম ট্যাক্স দেশে-এ মাত্র ১.৫% মানুষ দিয়ে থাকে, বাকিদের আয় হয় এতটাই কম যে সেটা ট্যাক্স আকর্ষণ করে না অথবা তাঁরা ট্যাক্স-টি ফাঁকি দেওয়ার কোনও উপায় খুঁজে বার করে ফেলেছে। মানুষের আয়ের সঙ্গে ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সের কোনও সম্পর্ক নেই। এর সম্পর্ক উৎপাদন এবং বিক্রয়-এর সঙ্গে। তাই এর থেকে দেশবাসীর মুক্তি নেই। যে কোনও ক্রেতা, সে ধনী হোক বা গরীব যদি এক-ই সামগ্রী কিনতে যায় তাকে একই হারে করযুক্ত দাম দিতে হয়।

জুন ৩০, ২০১৭ পর্যন্ত অনেক প্রকার পরোক্ষ কর ব্যবস্থা চালু ছিল। যেমন উৎপাদন-এর ওপর এক্সসিড ডিউটি, বিক্রয়-এর ওপর ভ্যালু এডেড ট্যাক্স (ভ্যাট), আন্তর্রাজ্য বিক্রয়-এর ওপর CST (সেন্ট্রাল সেলস ট্যাক্স), পরিষেবার ওপর সার্ভিস ট্যাক্স, কিছু কিছু রাজ্যে প্রবেশের জন্যে এন্ট্রি ট্যাক্স ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে এক্সাইজ্ এবং সিএসটি ছাড়া বাকি করগুলো রাজ্য সরকার ঠিক করত এবং সংগ্রহ করত। ভারতীয় সংবিধানে সেইরকম-ই নির্দিষ্ট ছিল। রাজ্যসরকারগুলি নিজের নিজের সুবিধা মতো করের হার নির্ণয় করার ফলে রাজ্যে রাজ্যে করের হার আলাদা হত। ফলে সামগ্রীর দাম-ও আলাদা আলাদা হত ।

এমন জটীল একটা কর ব্যবস্থাকে সরল করার উদ্দেশ্যে জিএসটি -র কথা ভাবা হল । প্রথম ভাবা হলো বাজপেয়ী সরকারের আমলে, যদিও আসল কাজ শুরু হল ২০০৬ সাল থেকে। উদ্দেশ্য সমস্ত পরোক্ষ কর তুলে দিয়ে একটা কর নিয়ে আসা, যাকে জিএসটি বা গুডস এবং সার্ভিস ট্যাক্স বলা হবে। এতো বড় একটা পরিবর্তন করার জন্যে দরকার ছিল সংবিধান সংশোধন, তাই কোনও সরকারের পক্ষে একা এই ব্যবস্থা প্রচলন করে ফেলা সম্ভব ছিল না, বিরোধীদের প্রত্যক্ষ সাহায্য প্রয়োজন ছিল। তাই একটা বৃহৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করা হল। তৈরী হলো জিএসটি কমিটি। যার মাথায় বসলেন একজন বিরোধী দল-এর রাজনীতিক। পশ্চিম বঙ্গের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গে বাম সরকার-এর পরাজয়-এর পর কেরলের মানি এবং আরও পরে অমিত মিত্র এর চেয়ারম্যান হন। বেশির ভাগ সিদ্ধান্তই সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়ে আইন তৈরী হল। সেটা পার্লামেন্ট-এ (দুই সভায়) গৃহীত হল। আরও ১৫টি রাজ্যের বিধানসভায় গৃহীত হল। তারপর রাষ্ট্রপতি সই করে একে আইনের মর্যাদা দিলেন। তারপর তৈরী হলো জিএসটি কাউন্সিল। যারা ঠিক করল কোন কোন সামগ্রীর ওপরে কত হরে কর নির্দিষ্ট হবে। করের হার এমন ভাবে স্থির করা হল যাতে যে কোনও সামগ্রীর বর্তমান দামে খুব বেশি হেরফের না হয়।

এরই পাশাপাশি চলল একটা বৃহৎ কম্পিউটার সিস্টেম তৈরির কাজ, কারণ GST ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পেপারলেস হওয়ার কথা। একটা ইন্টিগ্রেটেড কম্পিউটার সিস্টেম না থাকলে জিএসটি -র উদ্দেশ্য কোনও ভাবেই সফল হওয়া সম্ভব নয়। বহু পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে সেই সিস্টেম তৈরী হল।

জিএসটি -র ফলে যেটা সবচেয়ে লাভ হবে সেটা হল ভব্যিষতে সামগ্রী এবং পরিষেবার মূল্য কমবে। কারণ যে ট্যাক্স- অন-ট্যাক্স -এর ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল আগের ব্যবস্থায় সেটা এখন অবলুপ্ত। মানুষের হাতে কিছু বেশি টাকা থাকলে তারা বেশি খরচ এবং বেশি সঞ্চয় দুটোই করতে পারবে। সঞ্চয়ের টাকা শিল্প নির্মাণের কাজে লাগবে। আর খরচের টাকা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্টস কিনতে খরচ হবে। দুদিক দিয়েই যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। জিএসটির ফলে জিডিপি ২% বৃদ্ধির অনুমান রয়েছে। বিদেশী লগ্নিকারীদের কাছে জিএসটি অতি সরল একটা ব্যবস্থা যা বোঝা সোজা, মেনে চলাও সোজা। তাই বিদেশী লগ্নি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। GST সম্পূর্ণ কম্পিউটারইজিড হওয়ার ফলে কর ফাঁকি দেওয়া এখন প্রায় অসম্ভব। কারণ একজনের বিক্রয়ের তথ্য অন্যজনের ক্রয়ের তথ্যের সঙ্গে সহজেই মিলিয়ে দেখা যাবে কেউ ভুল তথ্য জানিয়েছেন কিনা? জিএসটি -র ফলে সরকারের আয় কমার কথা (কারণ ট্যাক্স- অন-ট্যাক্স-এর অংশটি আর পাওয়া যাবে না), যদিও অনেক বেশি মানুষ জিএসটি -র পরিধির মধ্যে চলে আসার ফলে আয় ভবিষতে ৩০% বাড়বে বলে অনুমান।

সম্যসা যে নেই তাও নয়। জিএসটি ব্যবস্থায় কম্পিউটারাইজড আ্যকাউন্টস খুব প্রয়োজনীয় একটা বিষয়। যেটা অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছে একটা খরচ সাপেক্ষ মাথাব্যথার কারণ। বছরে ৩৭ টি রিটার্ন জমা করতে হবে এবং পুরোটাই অনলাইন। ভুল তথ্য দেওয়ার জন্যে হাজতবাসের ব্যবস্থাও আছে। যদিও সেটা ভুলের জন্যে নয়, অপরাধের জন্যেই প্রযোজ্য হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

তাই সামগ্রিক ভাবে দেখলে জিএসটিতে (এক কর ফাঁকি দেওয়া ব্যবসায়ী বাদে) সকলেরই লাভ। তাই যদি হয় তাহলে এতো শোরগোল কেন? কারণ আমরা সাধারণ মানুষ যে কোনও পরিবর্তনেরই বিপক্ষে। সে ভাল হোক বা মন্দ। কোনও পরিবর্তন-ই আমরা স্বেচ্ছায় মেনে নিতে পারিনা। তাই সরকারকে জোর করতে হয়। এই ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। এই গেল গেল রব কয়েক মাসের মধ্যেই মিলিয়ে যাবে যখন সবাই সুফলটা বুঝতে পারবে।

Spread the love

Check Also

চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক

ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …

আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ

জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …

নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই

সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *