কমলেন্দু সরকার :
লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক ছিল গীতা দত্তের। লতা একবার বলেছিলেন, সহেলি গীতা দত্তকে আমি এখনও মিস করি।
গীতা দত্ত প্রয়াত হয়েছেন ৪৫ বছর হয়ে গেল। তবুও সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ এখনও ভুলতে পারেননি গীতা দত্তের সোনালি কণ্ঠ। লতা মঙ্গেশকর-গীতা দত্তের দ্বৈত কণ্ঠে ‘ক্যায়া বাতাউ মহব্বত হ্যায় ক্যায়া’, ‘আঁখিয়া ভুল গয়ি হ্যায় সোনা’ আজও কানে বাজে! লতা মঙ্গেশকরের সবচেয়ে প্রিয় গান নাকি ‘কাগজ কে ফুল’-এর গীতা দত্তের গাওয়া ‘ওয়াক্ত মে কিয়া ক্যায়া হাসিন সিতাম’।
গীতা দত্ত জন্ম পূর্ব বঙ্গের (বাংলাদেশ) ফরিদপুরের এক জমিদার পরিবারে। ১৯৩০-এর ২৩ নভেম্বর। তখন গীতা ছিলেন ঘোষ রায়চৌধুরী। চল্লিশের দশকের শুরুতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতা চলে এলেন গীতা। কলকাতা ছেড়ে ১৯৪২-এ সপরিবারে গীতারা চলে গেলেন বোম্বে (মুম্বই)। গীতা তখন স্কুল ছাত্রী। সেইসময় বলিউডের নামী সুরকার ছিলেন হনুমান প্রসাদ। মাত্র ১২ বছর বয়সি গীতার গান শুনে মুগ্ধ হনুমান প্রসাদ। তিনি মনে মনে ঠিক করে রাখলেন সুযোগ এলেই এই মেয়েটিকে দিয়ে প্লেব্যাক করাবেন। সুযোগ এসেও গেল। ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’-এ কোরাসের মধ্যে গীতাকে দিয়ে গাওয়ালেন আলাদা করে দুটো লাইন। বাজিমাত করলেন গীতা। বলিউডের সুরকারদের আলাদা করে নজরে এল সেই গলা। সবাই বিস্মিত! তাঁদের জিজ্ঞাস্য কে এই মেয়ে! গীতা তখন ভজন আর দু:খের গানই গাইতেন।
১৯৫১-তে আসমুদ্রহিমাচল দুলিয়ে দিয়েছিলেন গীতা ‘বাজি’তে গান গেয়ে! সেইসময় শচিন দেববর্মনের সুরে গীতার গান ‘তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির বানা লে’ লোকের মুখে মুখে ফিরত। তখন কেন, এখনও ফেরে!
গীতা ঘোষ রায়চৌধুরী হয়ে গেলেন গীতা দত্ত। ছবির গান রেকর্ড করতে গিয়ে আলাপ হল নায়ক-পরিচালক গুরু দত্তের সঙ্গে। গুরু দত্ত বহুদিন ভবানীপুরে থাকার সুবাদে ভাল বাংলা বলতেন। তাই গীতার সঙ্গে আলাপ জমে গেল। আলাপ থেকে প্রেম। ১৯৫৩-র গরমে গুরু দত্ত-গীতা ঘোষ রায়চৌধুরীর বিয়ে হল। ওঁদের দাম্পত্য সুখের জীবন খুব-বেশি দিন স্থায়ী হল না।
গুরু দত্তের সঙ্গে আলাপ হল এক সুন্দরীর সঙ্গে। সেই মেয়েটি দু’একটি তেলুগু ছবি করেছেন। নাম ওয়াহিদা রেহমান। ওয়াহিদা রেহমান শুধু সুন্দরী ছিলেন না। বেশ আভিজাত্যময় এবং বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। গুরু দত্তের ভাল লাগল। ওয়াহিদাকে বোম্বে (মুম্বই) নিয়ে এলেন।
‘সিআইডি’, ‘পিয়াসা’য় সুযোগ পেলেন ওয়াহিদা। বলিউডে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেনও। সেইসময় গুরু দত্ত-ওয়াহিদা রেহমানকে নিয়ে রসালো চর্চা চলত টিনসেল টাউনে।
ওদিকে গীতা দত্ত নিজেকে সরাতে শুরু করেছেন গুরু দত্তের জীবন থেকে। আলাদাও থাকছেন। ক্রমশ সুরাপানে আসক্ত হয়ে উঠলেন গীতা দত্ত। অন্যদিকে গুরু দত্তের জীবন থেকেও সরতে শুরু করেছেন ওয়াহিদা রেহমান। ওয়াহিদা ঘনিষ্ঠদের নাকি বলেছিলেন, আমি গুরু-গীতার জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। আমি চাই ওরা সুখে দাম্পত্যজীবন কাটাক। শোনা যায় নিন্দুকেরা বলেছিলেন, ওয়াহিদার কেরিয়ার গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ফুরিয়েছিল গুরু দত্তের!
গীতা দত্তের কাছেও ফিরতে পারেননি গুরু দত্ত। ১৯৬৪-তে গুরু দত্ত আত্মহত্যা করেছিলেন। যদিও পরিবারের লোকেরা তা মানেননি। যাই হোক, গীতা দত্ত আরও মুষড়ে পড়েছিলেন। মদ্যপান হয়ে উঠেছিল মাত্রাতিরিক্ত। তার সঙ্গে ঘুমের বড়িও খেতেন। আর্থিক সমস্যা বাড়তে শুরু করল। তিনি ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। ‘বধূবরণ’ ছবিতে অভিনয় করলেন। পারলেন না ঘুরে দাঁড়াতে। সিরোসিস অফ লিভারে মারা গেলেন ১৯৭২-এর ২০ জুলাই। অর্থাৎ আজকের দিনেই প্রয়াত হয়েছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা গায়িকা গীতা দত্ত।
গীতা দত্ত শুধু হিন্দি নয়, বহু হিট বাংলা গানও দিয়েছিলেন। আজও ভাল লাগে— ‘ওগো তুমি যে আমার’ (হারানোসুর), ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়’ (হসপিটাল), ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ’ (পৃথিবী আমারে চায়)। আরও কত গান গেয়েছিলেন গীতা দত্ত। বহু কণ্ঠ-কণ্ঠী আমরা শুনতে পাই কিন্তু গীতা দত্ত কণ্ঠী নেই বললেই চলে! কেননা, তাঁর কণ্ঠ এমনই ছিল যা নকল করা যায় না! তাই তো আশা ভোসলে বলেছিলেন, গীতা দত্ত থাকলে আমি এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না।