কমলেন্দু সরকার :
আষাঢ়ের বৃষ্টির আষাঢ়ে গল্প, সঙ্গে চপ মুড়ি চা। সন্ধেটা জমে ক্ষীর! ভূত আছে কি নেই, তর্কে গিয়ে লাভ কী! ভূত আছে ভেবে নিলে ক্ষতি কী! বেশ গা-ছমছমে ব্যাপার থাকে। হঠাৎ চমকে ওঠার ভাল লাগাও থাকে। আর কলকাতার ভূত হলে তো কথাই নেই। একদিন অফিস ফেরতা কিংবা একটা ছুটির দিন দেখে ভূত দর্শনে গেল মন্দ কী! হয়তো কড়া দুপুর ভূত দর্শন দেবে না, কিন্তু একটা ওই ওই আসছে শিহরন হবে।
জজ কোর্টের পাশে হেস্টিংস হাউস। আলিপুরে। ৩৪০ বছর হয়ে গেল বাড়িটার বয়স। এ বাড়িতে ভূত না-থেকে যায়! আছে তো। হেস্টিংসের ভূত। হেস্টিংস মানে যিনি সেই নন্দকুমারকে ফাঁসিতে লটকে ছিলেন। এই হেস্টিংস সাহেব তাঁর দেশে ফিরে গেলেন। কিন্তু একটা কালো বাক্স তাঁর নিয়ে যাওয়া হয়নি। ফেলে গিয়েছিলেন। এই কালো বাক্সর খোঁজে রোজই আসেন হেস্টিংস। না শরীরে নয়, অশরীরী হয়ে। সেই বাক্সে নাকি ছিল গোপন লেখা আর রহস্যময় ছবি। সেসব খুঁজতেই তিনি রোজই ঘোড়ার গাড়ি চেপে আসতেন! এই সাহেব ভূত অনেকেই নাকি দেখেছেন!
ওই বাড়িতে একটা পিয়ানোও ছিল। ওটি বাজাতেন কোনও এক মেমসাহেব। অবশ্যই তিনি ছিলেন মেম ভূত। গভীর রাতে পিয়ানোয় সুরের মূর্ছনা শুনেছেন অনেকেই। এমনকী আলিপুর জেলের বন্দিরাও শুনতে পেত পিয়ানোর সেই সুর!
কাছেই ন্যাশনাল লাইব্রেরি। এর পরিচিতি বেলভেডিয়ার হাউস নামেও। এই বাড়ির পশ্চিমদিকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে দুই ইংরেজ নেমেছিলেন মুখোমুখি লড়াইয়ে। নাম—- ওয়ারেন হেস্টিংস আর ফিলিপ ফ্রান্সিস। সুন্দরী মিসেস গ্র্যান্ড থাকতেন আলিপুর লেনের রেড গার্ডেন হাউসে। তিনি ছিলেন অতীব সুন্দরী। তাঁর স্বামী ফ্রান্সি গ্র্যান্ড বাড়িতে না থাকলেই গুটগুটি হাজির হতেন সেখানে কাউন্সিলার ফ্রান্সিস। হেস্টিংসও যেতেন ওই বাড়িতে। তবে লাটসাহেব বলে যখনতখন যেতে পারতেন না। ফ্রান্সিসের সেই অসুবিধে ছিল না। ওঁরা দু’জনই মিসেস গ্র্যান্ডের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। কিন্তু শ্রীমতী যে কার দিকে ঝুঁকে তা বোঝা যেত না!
ওই শ্রীমতীকে নিয়ে গুলির লড়াই হল একদিন। হার হল ফ্রান্সিসের। একটা পালকি করে রক্তাক্ত আহত ফ্রান্সিসকে শহরে পাঠানোর চেষ্টা হল। কিন্তু আদি গঙ্গায় বান ডেকেছে। ব্যস। পার হতে পারল না পালকি। ফ্রান্সিস মারা গেলেন। পালকি করে যেতে দেখা যায় আহত রক্তাক্ত ফ্রান্সিসকে!
বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছো! বাঙালকে হাইকোর্ট না দেখিয়ে ভূতের হাইকোর্ট দেখে আসা অনায়াসেই। এখানে নাকি সাজগোজ করা কবন্ধ নারী মূর্তির আবির্ভাব হয় রাতের বেলায়। হাইকোর্টের অনেকেই নাকি দেখেছেন তাকে!
এছাড়াও এক বিদ্রোহী কবির ভূতও ঘোরাঘুরি করে। সে আবার কুঁজো থেকে জল ঢেলেও খায়। আওয়াজও পাওয়া যায়—– ঢক ঢক ঢক! কবি তাপিস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে ছিল ব্রিটিশরা। তারই ভূত নাকি ঘুরে বেড়ায়! আরও ভূতের কথা শোনা যায় হাইকোর্টে।
কলকাতার ভূতের বাড়ির মধ্যে এক নম্বরে এক নম্বরি গারস্টিন প্লেসের বাড়িটি। এখানেই ছিল প্রথম রেডিয়ো অফিস। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামাওঠা করত ভূতেরা। এক বিদেশি ভদ্রলোককে দেখা যেত ফাঁকা স্টুডিয়োতে দাঁড়িয়ে থাকতে! এই বাড়িতে ভূতের উপদ্রব খুব ছিল বলে শোনা যায়।
কিছুটা রাইটার্স বিল্ডিং। এখানকার রাতপ্রহরীরা বহু অশরীরীর পায়ের শব্দ শুনেছেন। দেখেওছেন অশরীরীর ঘোরাফেরা। কোট-প্যান্টস-টাই পরা এক সাহেব ভূতকে প্রায়ই নাকি দেখা যেত রাইটার্সের ঘরে। তিন নম্বরি ব্লকের সিঁড়ির কাছে বুটের ভারী আওয়াজ শোনা যায়। দোতলার চার নম্বর ব্লকে দামি স্যুট পরা লাশ দেখা যায় পড়ে আছে আবার অদৃশ্যও হয়ে যায় মুহূর্তে!
গোটা ডালহৌসি এলাকা জুড়ে ভূতেদের যাতায়াত সংসার। জিপিওর এক কোণের ঘরে শোনা নূপুরধ্বনি। কখনও শোনা যায় কে যেন ধীরে ধীরে নামছে সিঁড়ি দিয়ে! শোনা ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি ডাক। কেউ কেউ দেখেছেন একটা স্বাস্থ্যবান ঘোড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা দোলাচ্ছে! কোনও কোনও সময় পাওয়া যায় সুন্দর আতরের গন্ধ। দেখা যায় সুন্দর সাজের এক অপূর্ব রমণী! তবে এদের দেখা মেলে রাতের বেলাতেই।
আহেরিটোলার কাছে পুতুল বাড়িও ভূতের বাড়ি হিসেবে পরিচিত। মাঝেরহাট ব্রিজের কাছে প্রাসাদোপম এক বাড়ির কাছে দেখা যেত লাল কুর্তা পরা একটি লোক কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়! তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই সহসা উধাও হয়ে যেত! রেসের মাঠের বিপরীতে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল। সেখান থেকে খালি ট্যাক্সি পেলেই উঠে পড়ে কলকাতা পুলিশের এক অফিসার। পিছন সিটে বসে। নেমে যায় চিড়িয়াখানার সামনে। কাউকে বিরক্ত করে না। শোনা যায়, বাগবাজারের গিরিশ ঘোষের বাড়ির মধ্যে থেকে কে যেন বলে, ‘ও বিনু, বিনু এলি!’ অনেকেই বলেন, গিরিশ ঘোষ নাকি নটী বিনোদিনীকে ডাকেন!
কলকাতার ভূতেদের কথা বললে শেষ করা যাবে না। তবে বোঝা যায়, খানদানি ভূতেরা জমকালো কিংবা পুরনো বড় বড়িতেই থাকতে পছন্দ করে।
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন