দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় :
বিজেপির রাজ্যসভাপতি দিলীপ ঘোষের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে আবার রাজনীতিতে শালীনতা-অশালীনতার প্রসঙ্গটি সামনে এসেছে। রাজ্যের বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে দিলীপ ঘোষ যে শব্দ ব্যবহার করেছেন তা হল, শয়তান এবং মানুষ তাঁদের কাপড় খুলে দেবে। এর আগেও দিলীপ ঘোষের মুখ থেকে এহেন অনেক কথা শোনা গেছে। শেষ দশ বছরের রাজ্য রাজনীতির ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে শালীন অশালীন বিষয়টি ফিরে ফিরে এসেছে।
নন্দীগ্রামের সময় সিপিএমের বর্ষীয়ান কৃষক নেতা বিনয় কোঙ্গার বলেছিলেন, তৃণমূলের নেতারা নন্দীগ্রামে গেলে সেখানকার মেয়েরা তাঁদের ‘পাছা’ দেখাবেন। এই নিয়ে রাজ্য জুড়ে সমালচনার ঝড় উঠেছিল। তবু বিনয় কোঙ্গার সেদিন কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, তিনি খারাপ কী বলেছেন! গ্রাম থেকে আসা বিনয়ের কাছে এই শব্দটি নেহাতই নিরামিষ। তাঁর অভিধানে মেয়েরা পাছা দেখাবে মানে পিছন ফিরে চলে যাবে। বিনয় কোঙ্গারকে ‘শবক’ শেখাতে গিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী একটি দৈনিক বাংলা পত্রিকায় পাছা শব্দে এক ডজনেরও বেশি প্রতিশব্দ লিখেছিলেন। সকালবেলা খবরের কাগজের প্রথম পাতায় পাছার অষ্টোত্তর শত নাম দেখে সাধারণ পাঠকের ভিরমি লাগলেও মহাশ্বতা দেবীর এই কলামটিকে কেউ অশালীন বলে উঠতে পারেননি। বরং এই রচনায় অশালীনতার চেয়ে বৌদ্ধিকতা খোঁজাই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন। এরপর কবীর সুমন কলকাতার মেট্রো চ্যানেলে একটি সভায় ছাপার অযোগ্য ভাষায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আক্রমণ করেছিলেন। সেদিন তাঁর কথায় এবং সামনে বসে থাকা মহিলাদের মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যে সম্ভবত অশ্লীলতার চেয়ে বেশি কিছু ছিল। এ ব্যাপারে সুমনকে জিজ্ঞাসা করা হলে সম্ভবত তাঁর কাছে কোনও সদুত্তর ছিল না। তাই তিনি এই প্রতিবেদকের প্রশ্নে কোনও অভিসন্ধি খুঁজে পেয়েছিলেন এবং মেজাজ হারিয়ে ফোন রেখে দিয়েছিলেন।
বিরোধী আন্দোলন করার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যা যা কটূক্তি শুনতে হয়েছে তার তুলনা মেলা ভার। সিপিএমের নেতাদের থেকে যেমন শুনতে হয়েছে তেমনই শুনতে হয়েছে সেইসব কংগ্রেসের নেতাদের থেকেও যাঁরা পরে মমতার ছাতার তলায় আশ্রয় নিয়েছেন এবং এখনও সেই আশ্রয়েই আছেন। ‘মমতার কেন বার বার বুকেই আঘাত লাগে?’ এই প্রশ্ন তুলেছিলেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। রাজনৈতিক মেধার জন্য গোটা দেশে সম্মানিত বামনেতা জ্যোতি বসুকে কেউ কখনও অশালীন কথা বলতে শোনেনি। তবে তাঁর আমলে মমতাকে যেদিন রাইটার্স থেকে চুলের মুঠি ধরে বের করে দিয়েছিলেন একজন পুলিশ অফিসার, সেই ঘটনা আর যাই হোক শালীন ছিল না। উদাহরণ আরও আছে। গঙ্গার জল বয়ে যেতে যেতে রাজ্যে তৃণমূলের সরকার হয়েছে। আইনজীবী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানুষ দেখেছে শিষ্টাচারের সীমা ছাড়াতে। বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহের জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও কু-ইঙ্গিত করেছিলেন কল্যাণ। আশালীনতার ক্ষেত্রে ‘দাদার কীর্তি’ এখনও অমর হয়ে আছে। সাংসদ অভিনেতা তাপস পাল ঘরে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করানোর কথা বলেছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ভরা সভায় ‘শালা’ বলতে শুনেছিল এই বাংলা। যদিও মুখ্যমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন।
জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুর মার্জিত বাংলা উচ্চারণের পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেঠো সহজিয়া শব্দচয়নকে একসময় অনেকে খুব খারাপ চোখে দেখত। ক্রমে বোঝা গেছে মমতার এধরণের ভাষা, কথা বলার ভঙ্গিমা, শব্দচয়ন টেলিভিশনে সান্ধ্যপর্দায় চোখ রাখা সোফা সেটের দর্শকদের যতই খারাপ লাগুক, রাজ্যের সাধারণ মানুষ মমতার সঙ্গে নিজেদের খুব দ্রুত একাত্ম করে ফেলছেন। মমতার ভাষায় সাধারণ মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন নিজের মনের কথা।
২০০৭-৮ এর প্রেক্ষিতে মমতা যে ভাষায় কথা বলতেন তা সহজে ছুঁয়ে যেত সাধারন মানুষের মন। ২০১৭-তে রাজনীতিক বুদ্ধিজীবী এমনকী সাংবাদিকদের প্রতিও মানুষের যে মনোভাব, ট্রেনে-বাসে এমনকী ফেসবুকে করা মন্তব্যেও সাধারণ মানুষের যে বিরক্তি, হতাশা ও ঘৃণা প্রকাশ পায় সেটি আঁচ করেই কী দিলীপ ঘোষ একেবারেই ‘রাস্তার ভাষায়’ কথা বলছেন! বিষয়টিকে শালীনতার প্রশ্নে দেখতে গিয়ে আমরা এর রাজনৈতিক দিকটি অবহেলা করছি কী!
টিভির সান্ধ্য টক-শোগুলিতে সাধারণত অশালীন ভাষা ব্যবহার হয় না। তবু এই টক-শোগুলি যে কলতলার ঝগড়াকেও লজ্জা দেয় তা নিয়ে সম্ভবত দর্শকদের কোনও দ্বিমত নেই।
তাছাড়া রাজনীতি চলে রাজনীতির নিয়মে। সেখানে সংবাদ মাধ্যমের পোশাকি সভ্যতার শিক্ষা খুব একটা কাজে লাগে না।
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন