গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় :
পাহাড়ে আগুন কি অবশ্যম্ভাবী ছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাওয়ার আগে একটা ব্যক্তিগত সংশয়ের উত্তর খোঁজবার চেষ্টা করি। আমাদের অর্থাৎ সমতলের মানুষদের মাঝে মাঝেই কেন পাহাড়ে বা জঙ্গলে যাওয়ার বাই ওঠে?
পাহাড় বা জঙ্গলকে আমরা, অর্থাৎ সমতলের মানুষরা এক পৃথক এবং অনন্য অস্তিত্ব বলে ভেবে থাকি বলেই কি পাহাড় আর জঙ্গলের প্রতি আমাদের দুর্মর আকর্ষণ? নাকি এমনও হতে পারে যে, যেহেতু মনুষ্য সমাজ উদ্ভূত হয়েছিল মূলত পাহাড় এবং জঙ্গল থেকে, সেই সূত্র ধরেই আমাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রাচীন গুহাবাসী সত্তার শিকড় ধরে এখনও টান দেয় পাহাড় এবং জঙ্গল? এবং শুধু সে কারণেই ইট, কাঠ, অ্যাসফেল্টের পিচ্ছিলতা আর শপিং মলের মাখন-সদৃশ আরামকেদারা ছেড়ে আমরা পাহাড় এবং জঙ্গলের রুক্ষতায় পৌঁছে জন্মভূমির স্বাদ পেতে চাই? জন্মভূমিই যদি হবে, তাহলে সে জন্মভূমি ত্যাগ করে আসবার পরেও সেই পাহাড় আর জঙ্গলের ওপর আমাদের এত অধিকার থাকে কী করে যে আমরা তাদের আত্মসাৎ করতে চাই? প্রশ্নের উত্তরে আরও প্রশ্ন আসে। তাহলে ওই পাহাড় আর জঙ্গল ঘিরে যে নৃগোষ্ঠী উঠে দাঁড়িয়েছে, তারা কি আমাদের অর্থাৎ সমতলের মানুষদের সত্তাকে পৃথক এবং বহিরাগত বলে মনে করে না? এখান থেকেই পাহাড়ে আগুনের প্রশ্নটা বিবেচনা করা যাক। তার শুরুটা করা যাক পাহাড়ের রাজনৈতিক অতীতের একটি পাতা থেকে।
‘‘কম্যুনিস্ট এবং পিএসপি-র মতো রাজনৈতিক দলের মূল কাজ সমস্যা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি করা। সিপিআই চাইছে, ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলি পুনর্গঠিত হোক। তাদের দাবি, দার্জিলিংয়ে গোর্খাদের জন্য পৃথক এলাকা সৃষ্টি করা হোক।’’
১৯৫৬ সালের মার্চের পয়লা একখানি চিঠিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিজের আশঙ্কার কথা লিখে জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। তারপর এ রাজ্যে কংগ্রেস শাসনের অবসান হয়। বামপন্থীরা প্রায় সাড়ে তিন দশক একাদিক্রমে শাসন করে এ রাজ্য, তখনও বার বার দার্জিলিং অশান্ত হয়েছে। কিন্তু বামপন্থীরা (এমনকী সিপিআই) তাদের সেই পুরনো দাবি নিয়ে আর রা-টি কাড়েনি। মনে আছে, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পাহাড়ে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, আর কত দেশটাকে ভেঙে ভেঙে টুকরো করবেন? তখন তৃণমূল কংগ্রেস পাহাড়ের আন্দোলন নিয়ে তদানীন্তন বাম সরকারকে দুষে বলেছিল, পাহাড়কে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলেই এত অশান্তি। যখন তৃণমূল ক্ষমতায় এল, তখন গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তৈরি হল, উন্নয়নের নামে সেখানে ইট, কাঠ, কংক্রিটের জোয়ার এল। তবুও পাহাড়ে আগুন ঠেকানো গেল না। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। পাহাড় তো হাসছিল, তবে হঠাৎ কেন এভাবে তেতেপুড়ে উঠল?
শাসক দলের অভিযোগ, সামনেই জিটিএ নির্বাচন, বিমল গুরুংয়ের দুশ্চিন্তা, নির্বাচনে আর তাঁর রাশ থাকবে না। কিছুদিন আগে যে পুর নির্বাচন হয়েছে সেখানে তৃণমূল যেভাবে তাদের পায়ের তলার মাটি কেড়েছে তাতে গুরুঙ্গের রাতের ঘুম গিয়েছে। শুধু তাই নয়, জিটিএ-র হিসাব নিয়ে এবার অডিট হবে, যেখানে টাকার গরমিল নজরে আসার ভয় আছে বিমল গুরুঙ্গ এবং তাঁর সঙ্গীসাথিদের। অতএব ক্ষমতা হারানোর ভয় এবং সম্মান খোয়াবার আশঙ্কা বিমল গুরুঙ্গকে ফের জঙ্গি আন্দোলনের শরিক করেছে। ধরে নেওয়া যাক, সরকার বা শাসক দল যা বলছে তা ঠিকই বলছে। হয়তো বিমল গুরুঙ্গের পূর্বের দাপট কমেছে, হয়তো তাঁর সঙ্গীদের কেউ কেউ টাকার হিসাবে গরমিলও করেছেন। কিন্তু এই বিমল গুরুঙ্গ পিছু হঠলেই কি পাহাড় ফের হাসতে শুরু করবে? এ প্রশ্নটাই রাজ্যের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটাই নিজেদের সামনে রেখে সমাধানের পথ খোঁজা উচিত সরকারের।
পাহাড়ে উন্নয়নের প্রশ্নে দ্বিমুখী কৌশল নিয়েছে রাজ্য সরকার। একদিকে পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়নের বিস্তার এবং অন্যদিকে তৃণমূলের বিস্তার। তাতে ফলও মিলেছে খানিকটা। পাহাড়ে কিছু সমস্যার যেমন সমাধান হয়েছে তেমনই তৃণমূলও তার ডানা বিস্তার করতে পেরেছে খানিকটা। সরকারের কাছ থেকে জিটিএ-র হাতে টাকা আসায় বিমল গুরুঙ্গরা খানিকটা সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে তাঁরা আন্দোলনের পথে নামেননি বহুদিন। যে-কারণে রাজ্য সরকার মুখ বড় করে বলতে পেরেছে, পাহাড় হাসছে। অন্যদিকে পাহাড়ের জনজাতিদের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য একাধিক পৃথক উন্নয়ন সংস্থা গড়ে দেওয়ায় তারা সম্মানিত বোধ করেছে। সেই সুযোগে তৃণমূল নেত্রী তাঁর দলের মাহাত্ম্য প্রচার করতে পারায় পাহাড়ের জলে-হাওয়ায় ধীরে ধীরে তাঁর দল পুষ্ট হয়েছে। কিন্তু এই আপাত উৎসবের আড়ালেই পাহাড়ের মধ্যে চিড় ধরা পড়ছিল।
পাহাড়ের বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের মধ্যে যে সুক্ষ্ম রাজনৈতিক কৌশল ছিল সরকারের, তা পাহাড়ের সরল সামাজিক সমীকরণের সঙ্গে মেলে না। সরকার চাইছিল না, পাহাড়ে কোনও বিশেষ জনজাতি বা নেতৃত্বের হাতে সমস্ত ক্ষমতা পুঞ্জীভূত থাক। সরকারের এই সিদ্ধান্তে সাময়িকভাবে বিভিন্ন উপজাতি খুশি হল ঠিকই কিন্তু সমতলের এই জটিল রাজনৈতিক মানসাঙ্ক পাহাড়ের রুক্ষ সারল্যের সঙ্গে সবসময় খাপ খাচ্ছিল না বলে উত্তাপ ধিকিধিকি জ্বলছিল। সরকারের গোয়েন্দা দফতর সেই উত্তাপের আঁচ বিন্দুমাত্র টের পায়নি। যখন টের পেল তখন দেরি হয়ে গিয়েছে।
বিমল এবং তাঁর সমর্থকেরা এখনও পাহাড়ে নির্ণায়ক শক্তি। তাঁদের মনে হয়েছে, পাহাড়ের জনজাতিকে বিভিন্ন উপায়ে খণ্ডিত করা হচ্ছে। এতে তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হচ্ছেই সেই সঙ্গে সমতলের এই জটিলতা পাহাড়ের সরলতাকে গ্রাস করছে। মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে মন্ত্রিসভা উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর বিমল গুরুঙ্গদের আশঙ্কা গাণিতিক হারে বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী দার্জিলিং পরিদর্শনের সময় পাহাড়ের কোনও নেতা-নেত্রীকে পাশে দেখা যায়নি, তাঁর সঙ্গী হয়েছেন অরূপ বিশ্বাস নামে এক মন্ত্রী, যাঁর সঙ্গে পাহাড়ের কোনও মানসিক যোগই নেই। সমতলের এই যে পাহাড় অধিগ্রহণ, তা পাহাড় মেনে নিতে পারছিল না। অন্তত গুরুঙ্গ পাহাড়বাসীর মনে সরকারের বিরুদ্ধে সে অবিশ্বাসের বীজ বপণ করে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
এরপর সরকার যদি পুলিশ আর সেনা মোতায়েন করে সেখানকার সমস্যার পূর্ণ সমাধান করতে চায়, পাহাড় কতটা মেনে নেবে বলা মুশকিল। ঘিসিং পিছু হটে যেমন গুরুঙ্গকে জায়গা করে দিয়েছেন, গুরুঙ্গ পিছু হঠলে আবার যে-কেউ তাঁর জায়গা নেবে না, সে কথা কেউ বলতে পারেন না।
সরকারের যেমন সতর্কতার প্রয়োজন তেমন বিরোধীদেরও ঘোলা জলে মাছ ধরার সময় নয় এটা। মাথায় পাগড়ি বেঁধে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ সমতলে জনসভা তাতাতে পারেন, কিন্তু তাঁকে মনে রাখতে হবে, যদি তাঁরাও কোনওদিন এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসেন (যদিও তা এখন কল্পনার অতীত), তাঁরাও একই বিপাকে পড়বেন, যদি-না পাহাড়ের স্বকীয় অস্তিত্বকে অন্তর থেকে মেনে না নেন।