দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় সঞ্জয় বাৎস্যায়ন
সালটা ‘ঐতিহাসিক ভুল’- এর, ১৯৯৬। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এন টি রামারাওকে দেখতে গিয়েছেন সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদক এ বি বর্ধন। সঙ্গী এরাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রী।কী ভাবে অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেগু দেশম গড়ে তুললেন, সেই স্মৃতি চারণা করছিলেন এন টি আর। প্রথম নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য লোককে টাকা দিতে হয়েছিল তেলেগু ম্যাটিনি আইডলকে। বুথ পিছু এজেন্ট বা কর্মী তো তখন স্বপ্ন। তবু দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কংগ্রেসকে ধরাশায়ী করেছিলেন চন্দ্রবাবু নাইডুর শ্বশুরমশাই। এন টি আর-এর কথায়, রহস্যটা ছিল ‘পালস’ বোঝায়। অন্ধ্রের মানুষ যে কংগ্রেসের একটা বিকল্প চাইছেন তা বুঝতে ভুল হয়নি তেলুগা বিড্ডার। সেদিন বর্ধনের সঙ্গী, রাজ্যের সেই প্রাক্তন মন্ত্রীর গলায় ঝরে পড়ছিল হতাশা। ‘‘ আজ বামপন্থীরা, বিশেষত সিপিআই(এম) মানুষের পালসটাই বুঝতে পারছে না। বুথে কজন এজেন্ট বসল, আদৌ বসল কি না, সে সব দিয়ে কিছু হয় না। দরকার মানুষ কি চাইছেন সেটা বোঝা।’’ সিপিআই নেতার মতে, মানুষের সেই চাওয়া না চাওয়ার হদিশ পেতে গেলে বামেদের রাজনৈতিক গণ্ডিটা আরও বড় করতে হবে। নামে না হলেও কাজে অন্তত বামফ্রন্টকে বড় করতেই হবে।
ফ্রন্ট বড় করার এই দাবিটা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। বামফ্রন্টের ভিতরে সিপিআই (এম)—এর ‘দাদাগিরি’ নিয়ে বহুদিনই সরব ফ্রন্টের ছোট শরিকরা। সিপিআই-এর মতো আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকও তাই ফ্রন্ট বড় করার পক্ষে। এসইউসিআই, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন, এমনকি ভাঙড়ের আন্দোলনের প্রধান সংগঠক রেড স্টারকেও ফ্রন্টে সামিল করার পক্ষে তারা। ব্যপকতর বাম ঐক্যের স্বার্থেই। সেক্ষেত্রে বামফ্রন্টের নামে ‘‘বাম’’ রাখার কোনও আপত্তি দেখছে না এই শরিকরা। কিন্তু, আপত্তি আছে নকশালপন্থী লিবারেশন বা এসইউসিআই-এর। সেই ৬৭-তে PULF আৱ ULF মিলে যুক্তফ্রন্ট তৈরির সময় সিপিআই (এম এল) বা নকশালদের রাজনৈতিক জন্ম। জন্মলগ্ন থেকেই যুক্তফ্রন্ট, ৭৭-র পর বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে ‘সংগ্রাম’ করে এরাজ্যে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে পরবর্তীকালে নকশালপন্থীদের বিভিন্ন গ্রুপ। তাই পরবর্তী সময়ে, বিশেষত ২০১১-র পর বারবার আহ্বান এলেও, সেই বামফ্রন্টে যোগ দিতে সায় দেয়নি তাঁরা। এর মধ্যেই বামফ্রন্টের কৃতকর্মের তালিকায় যুক্ত হয়েছে সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম। ভূমি- সংস্কার আর পঞ্চায়েতের সাফল্যের থেকেও যে ‘ব্যর্থতা’ বা ‘বিচ্যুতি’-কে আরও গুরুভার মনে করেন লিবারেশন নেতারা। যুক্তফ্রন্টের দুটি সরকারে থাকলেও পরবর্তী সময়ে ৩৪ বছরের বাম শাসনকালে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধেই থেকেছে এসইউসিআই। মোটের উপরে বামফ্রন্টে যাওয়া নিয়ে তাদেরও মত নেই। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের দায় বহনকারী বামফ্রন্টের বাইরে থাকতেই স্বচ্ছন্দ তাঁরা। যদি নাম বদল হয়? কাজে ‘বাম’ হলেও নামে আর ‘বাম’ না থাকে বামফ্রন্টে? সেক্ষেত্রে ভেবে দেখতে আপত্তি নেই লিবারেশন সহ নকশালপন্থী ও এসইউসিআইএর। তবে, সেই নাম বদল যদি ‘বাম’ চরিত্র বদলের জন্য হয় তাতে সায় নেই অতি বামেদের। ভবিষ্যতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধতে যদি ‘বামফ্রন্টে’ হাইফেন হয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ বসে যায়, তবে সাড়া দেবে না এসইউসিআই-ও।
অন্যদিকে কংগ্রেস, আরজেডি সহ আঞ্চলিক ও জাতীয় স্তরের গণতান্ত্রিক দলগুলোর সঙ্গে ‘সহজ’ সম্পর্কের প্রয়োজনেই ফ্রণ্ট থেকে ‘বাম’ নাম খসে যাওয়াই মঙ্গলের বলে মনে করে পিডিএস। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-নেতাই -এর সূত্রে ‘সিপিএম’-এর মতো ‘বামফ্রন্ট’-ও ‘ডিসক্রেডিটেড নেম’ বলে মনে করেন সমীর পূততুণ্ড। তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ জিজ্ঞাসা ‘‘জনসংঘ থেকে বিজেপি হয়ে যদি আজকের অবস্থায় পৌছানো যায় তবে নামের জন্য অত নামাবলির প্রয়োজন কোথায়?’’
নাম বদলের চাহিদা সিপিআই(এম)-এর অন্দরেও আছে। যুক্তি অনেক। প্রথমত, কেরলে ‘বাম’ নয় ‘বাম গণতান্ত্রিক’ ফ্রন্ট। এরাজ্যে হলেই বা মন্দ কি? দ্বিতীয়ত, একবার নয় দলের বামফ্রন্ট (ডিএসপি ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর) আবার 17 দলের বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলোর বৈঠক করে বারবার আলাদা কর্মসূচী নেওয়ার প্রয়োজনটাও তাতে থাকে না। সময় বাঁচবে, জটিলতা কমবে। তবে, সেখানেও প্রশ্ন উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে। উদ্দেশ্য কি ভবিষ্যতে বাম জোটের সঙ্গে কংগ্রেসের জোটের পথ খোলা? তাহলে দলের কট্টপন্থী অংশ বাগড়া দেবে। আর যদি উদ্দেশ্য হয়, অতিবাম থেকে সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক সবাইকে এক ছাতার তলায় আনা তবে, ‘সাধু সাধু’ বলতে আপত্তি নেই বড় শরিকের। প্রশ্ন আছে বিধেয় নিয়েও। আরজেডি, পিডিএস, লিবারেশন, এসইউসিআই-নিজের নিজের যুক্তি ও ব্যাখায় এতদিন বামফ্রন্টে সামিল হয় নি। হবেও না। তবে কি নাম পরিবর্তনই ভবিতব্য? সঙ্গে ‘গণতান্ত্রিক’ বা অন্য কিছু জুড়তে হবে? সমস্যা সেখানেও। অতিবামেরা, গণতন্ত্রের নামে আদর্শের লঘুতা মানবে না। সমাজতন্ত্রী বা গণতন্ত্রীদের আবার আদর্শের কঠোরতাতেই আপত্তি। তাদের উৎসাহ ফ্রন্ট থেকে ‘বাম’ বিদায়ে।
শেক্সপিয়র যাই বলুন, এ রাজ্যে বামেদের জোট ভবিষ্যত আপাতত নামের গেরোতেই আটকে। আর সেই নামকরণ উৎসবের প্রধান কাঁটা কংগ্রেস। পার্টি কংগ্রেসে কারাত বনাম ইয়েচুরি শিবিরের লড়াইয়ের ফলাফলে সিপিআই(এম)-এর একার নয়, বামফ্রন্টেরই ভাগ্য ঝুলে রয়েছে।
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন