দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মধুমন্তী
:
নিরদ সি চৌধুরী তখন বেঁচে। লালকৃষ্ণ আডবাণী দেখা করতে গেছেন। আডবাণীর সঙ্গে দু’চারটে কথা বলার পর কোনও একটা কারণে নিরদচন্দ্র চুপ করে গেলেন। কী হল নিরদ সি-র! আডবাণী নাকি সংস্কৃত বলতে গিয়ে ভুল করেছিলেন তাঁর সামনে। ঠোঁটকাটা নিরদ সি সেদিন আডবাণীকে বলতে দ্বিধা করেননি ভাল করে সংস্কৃত না জেনে হিন্দুত্ব নিয়ে রাজনীতি করবেন কি করে?
যদিও-বা পাণ্ডিত্যের দিক থেকে তখন বিজেপিতে স্বর্ণসময়। বাজপেয়ী, আডবাণী, যশবন্ত সিনহার মতো শিক্ষিত মানুষের হাতে তখন দলের লাগাম। এখন বিজেপি নেতৃত্বের ধরন বদলেছে। তবু মোদী-অমিত-জেটলির বিজেপিরও সম্ভবত সংস্কৃতটা কাঁচা। অন্তত বিজেপি শাসিত সরকারের মান্ডি হাউসের সেন্সর বোর্ডের কার্যকলাপে এমনটাই মনে হয়। যে-সংস্কৃত সাহিত্য এদেশের সনাতন সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সেই সাহিত্যের পাতায় পাতায় যৌনতার জয়গান। মেঘদূতম কিংবা কুমারসম্ভবম, বাসবদত্তায় যৌনতার অবাধ প্রবেশ। খাজুরাহ, কোনার্কে মন্দির গাত্রের ভাস্কর্য মৈথুন মূর্তির সমারোহ। এহেন সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে যৌনতা নিয়ে ছুঁৎমার্গ কীভাবে আধুনিক ভারতের সংস্কৃতি বোধে ঢুকে পড়ল এ এক বিস্ময়!
চলচ্চিত্রে চুম্বন, শরীরী সম্পর্ক, এসবের গন্ধ পেলেই সেন্সর বোর্ডের কাঁচি কচকচিয়ে ওঠে। যেদেশে কন্ডোমের বিজ্ঞাপন টিভির পর্দায় ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ বার দেখা যায় সেদেশে ইমতিয়াজ আলি পরিচালিত ‘জব হ্যারি মেট সেজাল’-এর ট্রেলারে অনুষ্কার মুখে ‘ইন্টারকোর্স’ শব্দটি শুনে হইহই করে উঠছেন সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান পেহেলাজ নিহ্লানি। মজার কথা পেহেলাজ যে-সরকারের আধিকারিক সেই সরকারের একটি বিজ্ঞাপনের ক্যাচ লাইন— ‘এক কে সাথ, ইয়া নিরোধকে সাথ’। লক্ষ করার বিষয় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরের এই বিজ্ঞাপনটি কত উদার! এখানে স্বাস্থ্যের কারণে যৌনতার সীমা টানা হলেও সামাজিক কারণে নারী পুরুষ অবাধ মিলনে কোনও দাঁড়ি বসায়নি স্বয়ং সরকার বাহাদুর। কিন্তু সিনেমায় নারী শরীর, যৌনগন্ধী শব্দ এলেই মান্ডি হাউজের বাহাদুরি শুরু হয়ে যায়।
অন্যদিকে ২১ জুলাই মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে অলঙ্কিতা শ্রীবাস্তবা’র প্রথম ছবি ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বোরখা’। যা ইতিমধ্যেই একাধিকবার সেন্সর বোর্ডের কোপের মুখে পড়েছে। কারণ, ছবিটি নারীকেন্দ্রিক, যেখানে দেখানো হয়েছে মেয়েদের যৌনকল্পনা, অডিয়ো পর্নোগ্রাফি এবং নাকি কিছু অশালীন শব্দ। সেইসঙ্গে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই ছবির পোস্টার। যেখানে বাম হাতের মধ্যমায় অশালীন ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা। ঘটনাটি ভারতবর্ষের সমসাময়িক রাজনীতির সামনে একটি বড় প্রশ্ন চিহ্ন দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। যাঁরা ভারতীয় সনাতন সভ্যতার ও সংস্কৃতির উজ্জীবন ও প্রতিষ্ঠা চাইছেন তাঁদের এই দেশ সম্পর্কে ধারণায় গোড়ায় গলদ রয়ে যায়নি তো! শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ কিংবা জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ সম্ভবত তাঁদের পড়া নেই। হয়তো-বা পড়েও ভুলে গেছেন। শূদ্রক কিংবা জয়দেব যেভাবে নারীর যৌন ইচ্ছার বর্ণনা করেছেন সেই তুলনায় অলঙ্কৃতার ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বোরখা’ নেহাতই দুগ্ধপোষ্য শিশু।
যে-দেশে মাতৃ পূজার মন্ত্রে ‘কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে’ কিংবা ‘পীন্নোনত পয়োধরা’ শব্দবন্ধের ছড়াছড়ি সেখানে সিনেমার পর্দায় নারীর স্তন দেখে বুকফাটা হাহাকার জুড়ে দেন সেন্সর বোর্ডের বাবু-বিবিরা। এমনটাই ঘটেছিল একবছর আগে ‘পার্চড’ ছবির ছাড়পত্র দেওয়ার সময়।
ছবির একটি দৃশ্যে রাধিকা আপ্তে’র খোলা বুক দেখে বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছিল মান্ডি হাউসের। সেন্সর বোর্ডে উঠেছিল গেল গেল রব।
সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনায় প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল উদার। ৪০০ বছরের মোঘল শাসনের ‘আব্রু’ আর ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের ‘পিউরিটান’ সংস্কৃতি কী আধুনিক ভারতের মস্তিষ্কে অদৃশ্য কোনও নীতি পুলিশ বসিয়ে দিয়ে গেছে! বলতে পারবেন পণ্ডিতেরা। আমরা শুধু বলতে পারি সাবলক হও ভারতীয় সেন্সর বোর্ড, বেলা যে পড়ে এল।
দেখুন ভিডিয়ো :
লাইক, শেয়ার ও মন্তব্য করুন
ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন