Breaking News
Home / TRENDING / পাশবিক

পাশবিক

ইন্দ্রনীল সান্যাল   :
বৈশাখের দুপুর দু’টোর চাঁদিফাটা গরম সহ্য করে একদল বেকার পাবলিক কলেজ স্ট্রিটের রেলিং-এ কনুই রেখে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। এত মন দিয়ে লোকে ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ ছাড়া কিস্‌সু দেখে না। অমলও দাঁড়িয়ে গেল। মেডিক্যাল কলেজ থেকে মায়ের ডেথ সার্টিফিকেট পেতে দুঘন্টা দেরি আছে। ততক্ষণ টাইম পাস করতে হবে।
উল্টোদিকেই মেডিক্যাল কলেজের ফুটপাথ। তার রেলিং ঘেঁষে রান্না করছে বছর ত্রিশের এক ফুটপাথবাসিনী। কালো, রোগা, গায়ে ময়লা, মাথার চুলে জট। কোলে টিকটিকির সাইজের একটা বাচ্চা মাধ্যাকর্ষণকে উপেক্ষা করে ঝুলে রয়েছে। ডেভেলপমেন্টের বিভিন্ন স্টেজে থাকা তিনটে বাচ্চার কেউ ফুটপাথে হামাগুড়ি দিচ্ছে, কেউ সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে হিহি করে হাসছে, কেউ হাঁটা রপ্ত করে নিয়ে বাপকে ধরে র্যাউন্ডাম থাবড়াচ্ছে। পাতাখোর বাপ একটা ভাঙা ট্রানজিস্টার স্টেপ বাই স্টেপ খুলে ফেলার চেষ্টায় ব্রতী। জগৎ সংসারের অন্য বিষয়ে আগ্রহহীন।
অমল এবং কলকাতার বেকার পাবলিকরা এদের দেখছে না। তারা দেখছে একটা মাদি কুকুরকে।
ফুটপাথ ঘেঁষে, রাস্তার ওপরে একটি কুকুরের বাচ্চা মরে পড়ে আছে। থ্যাঁতলানো মাথা, ফেটে যাওয়া পেট। বুঝতে অসুবিধে হয় না কুকুরের বাচ্চাটা গাড়ি চাপা পড়ে মরেছে একটু আগে। এখনও রক্ত জমাট বাঁধেনি। কুকুর মায়ের আরও পাঁচটা বাচ্চা ফুটপাথে ঘুরঘুর করেছে। এটা ওটা শুঁকছে, ল্যাজ নেড়ে মানুষ মায়ের কাছে জানতে চাইছে কী রান্না হচ্ছে, তাড়া খেয়ে কেঁউ কেঁউ করে পালাচ্ছে।
সন্তানের মৃত্যুতে হোক বা গরমে, কুকুর মা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। চোয়ালের ফাঁক দিয়ে ঝিকিয়ে উঠেছে শ্বদন্ত। সে একবার থ্যাঁতলানো সন্তানকে শুঁকছে, একবার ঘাঁউ ঘাঁউ চিৎকার করে ছুটন্ত লরির দিকে তেড়ে যাচ্ছে, পর মুহূর্তে এক হাত জিভ বার করে হাঁফাচ্ছে। সব চেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার হল পাগলা কুত্তি একের পর এক পথচারীকে কামড়ে দিচ্ছে। পথচারীদের পূর্বনির্দিষ্ট এই কামড় দেখতেই কলকাতার বেকার জনগণ এই রোদে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইনফ্যাক্ট, দর্শকদের মধ্যে বাজি ধরা শুরু হয়ে গেছে। প্রথম দর্শক বলল, ‘এবার লাল শার্টকে কামড়াবে!’
লাল শার্ট পরা কলেজ ছাত্র জানেও না তার জন্যে কী অপেক্ষা করে আছে। মরা বাচ্চাটার কাছাকাছি আসা মাত্র কুকুর মা ‘ঘ্যাঁক’ করে তার হাঁটুতে দাঁত বসাল। ছোকরা ‘বাপ রে!’ বলে চিৎকার করে দৌড় দিল। একটু দূরে গিয়ে দেখে নিল, প্যান্ট ছিঁড়েছে, হাঁটু থেকে দরদর করে রক্ত বেরোচ্ছে।
অমল বলল, ‘চোদ্দটা ইনজেকশান।’
তৃতীয় দর্শক বলল, ‘এখন পাঁচটা নিলেই হয়ে যায়।’
প্রথম দর্শক বলল, ‘এবার ওই মুটেকে কামড়াবে!’
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কুকুর মুটের থাইতে দাঁত বসিয়েছে। সে ‘মাই রে মাই!’ বলে দৌড় দিল। পরবর্তী আধঘন্টায় আরও দশজন কুকুরের কামড় খেল।
মানুষ মায়ের রান্না শেষ। ইটের উনুন নিবিয়ে সে কোলের বাচ্চাটাকে ঠক করে ফুটপাথে বসিয়ে জটিল ভাষায় নিকম্মা বরকে গালিগালাজ করল। একটা কুকুরছানার কান ধরে ঝুলিয়ে কুকুর মায়ের কোলের কাছে নিয়ে গিয়ে মুখটা মাইতে ঠেসে দিল।
সুধারস টেনে নিচ্ছে সন্তান। পাগলা কুত্তি এখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। শ্বদন্ত মুখের ভিতরে ঢুকে গেছে।
মানুষ মা টুক করে মরা বাচ্চাটাকে ভ্যাটে ফেলে দিয়ে বাকি কুকুরছানাদের মায়ের দিকে ঠেলে দিল। তারপর নিজেরা খেতে বসল।
অমল দেখল মানুষ মা আর কুকুর মা সন্তানদের খেতে দিচ্ছে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা পাবলিকের দঙ্গল নতুন মজার খোঁজে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে।
ফাঁকা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে অমল বলল, ‘মা!’

Spread the love

Check Also

চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক

ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …

আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ

জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …

নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই

সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *