কমলেন্দু সরকার :
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান বাঙালির উন্মাদনা। হেমন্তর কণ্ঠ ভাল লাগে না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছিল স্বর্ণ কণ্ঠ। কী সব গান গেয়ে গেছেন তিনি! কী হিন্দি, কী বাংলা। আজও কান ভরে ওঠে সুরে সুরে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্ম বেনারসে। বিশ শতকের প্রথম দিকে ওঁরা সপরিবারে চলে এলেন কলকাতায়। তাঁর পড়াশোনা ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনে। আইএ পাশ করার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য। কিন্তু গানের জন্য সবকিছু ছেটে দিলেন। যদিও প্রথম জীবনে সাহিত্যিক হওয়ার বাসনা ছিল প্রবল। এ ব্যাপারে তাঁর বাল্যবন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহ ছিল। কিন্তু পরে সুভাষ মুখোপাধ্যায় দেখেছিলেন লেখা নয়, গানটাই হবে হেমন্তর। “তাই আমি বললাম তুই লেখক হওয়ার ইচ্ছেটা ত্যাগ কর। গানটাই ভাল করে কর।” এ কথা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছেই শোনা।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম গান গাওয়া অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর জন্য। শৈলেশ দাশগুপ্তের সুর। গানট ছিল— আমার গানেতে এল নবরূপী চিরন্তন। সময়- ১৯৩৩।
১৯৩৭। কলম্বিয়ার জন্য গাইলেন। গানের লেখা- নরেশ ভট্টাচার্য। সুর- শৈলেশ দাশগুপ্ত। গান দু’টি ছিল— জানিতে যদি গো তুমি এবং বলো গো মোরে। এরপর থেকে নিয়মিত রেকর্ড করে গেছেন কলম্বিয়া থেকে। ১৯৪০-এ সুরকার কমল দাশগুপ্ত হিন্দি গান গাওয়ালেন হেমন্তকে দিয়ে। কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে এবং ও প্রীত নিভানেবালি গান দু’টি লিখেছিলেন ফৈয়াজ হাশমি।
১৯৪১-এ প্রথম প্লেব্যাক করলেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবিতে। হিন্দিতে প্রথম প্লেব্যাক ‘ইরাদা’ ছবিতে। প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা বাংলা ছবি ‘অভিযাত্রী’তে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছোটবেলার একটা স্মৃতি প্রায়ই তাঁর মনকে নাড়া দিত। হেমন্তদের পারিবারিক দেবতা ছিলেন দধিমাধব। ছোটবেলায় তিনি দেখতেন ঠাকুমা ছিলেন দধিমাধব অন্ত প্রাণ। একদিন দেখলেন ঠাকুমাকে একটা চাপিয়ে, শুইয়ে দিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাড়ির সবাই বলছে— চান্দ্রায়ণ। সেটা আবার কী! অবাক বালক হেমন্ত। যাওয়ার সময় একবার ঘুরে গেলেন মন্দির। সেই রাতেই মারা গেলেন ঠাকুমা। হেমন্ত বড় হয়ে বুঝেছিলেন আসলে ওটা ছিল অন্তর্জলিযাত্রা। বাড়িতে কেউ মৃত্যুমুখে থাকলে তাকে নিয়ে যাওয়া হত গঙ্গার ধারে। আধা শরীর থাকত জলে আর আধা ডাঙায়।
হেমন্তর যেমন অনিন্দ্যসুন্দর ছিলেন, তেমনই ছিল তাঁর হৃদয়। হেমন্ত যখন কলকাতা-মুম্বই দু’জায়গাতেই ছিলেন খ্যাতির শিখরে তখনও গাড়িতে যাওয়ার সময় যদি দেখতেন তাঁর বন্ধু হেঁটে যাচ্ছে সঙ্গেসঙ্গে তাকে গাড়িতে তুলে নিতেন। এমন আকছারই ঘটত। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কাউকে উদ্দেশ করে ডাকছেন তা দেখতে লোক জমে যেত। তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করতেন না তিনি। যতক্ষণ-না বন্ধু আসছে ততক্ষণ ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতেন। এমনই ছিলেন তিনি।
আরও একটা ঘটনা শুনেছিলাম উৎপলাদির কাছে। এক রবিবার সকালে গিয়েছিলাম উৎপলাদির বাড়ি। এ কথা, সে কথার পর হেমন্তদার প্রসঙ্গ উঠল। উৎপলাদি বললেন, “শোন, একবার আমি, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্তদা গিয়েছিলাম হুগলি মহসিন কলেজে। অনুষ্ঠান শেষ। হেমন্তদার হাতে একটা খাম দিয়ে গেল। উনি নিয়ে পকেটে ভরে নিলেন। খুলেও দেখলেন না। তারপর আমরা সবাই হেমন্তার গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে হেমন্তদা খামটা খুললেন। দেখলেন কয়েকটা দশ টাকার নোট। মেরেকেটে টাকা কুড়ি-তিরিশ। আমরা সবাই অবাক! গাড়ি ঘোরাতে বললাম। হেমন্তদা কিন্তু শান্ত কোনওরকম বিরক্তি নেই। বললেন, ”ছাড় না। ওরা সব ছাত্র কোথায় পাবে। বরং চল ওই সামনে তেলেভেজা ভাজছে, খাই।”
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো সুভদ্র মানুষ আমি কম দেখেছি। এতবড় মানুষ অথচ কি সুন্দর ব্যবহার! অবাক হয়ে যেতাম। যখন তাঁর মেনকা সিনেমা হলের উলটো দিকের ফ্ল্যাট থেকে কথা বলে বেরিয়ে আসতাম উনিও পিছন পিছন এসে লিফট পর্যন্ত আসতেন। একদিন হেমন্তদা ফোন করলেন, “জনেট ফ্যয়ে বলে একটি মেয়ে আমেরিকা থেকে এসেছে খুব ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। তোমার কাগজে লিখতে পারো।” তখন আমি আনন্দবাজার-এ। তা গেলাম হেমন্তদার বাড়ি। উনি পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর অনেক কথা হল। বাড়িতে কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও বেলাদিকে বললেন, “বেলা, তুমি চা-টা তুমিই করো।” বেলাদি চা-খাবার করে আনার পর হেমন্তদা নিজে পরিবেশন করলেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন খুব বন্ধুবৎসল। এটা আমাকে বলেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, “হেমন্ত বহুদিন বাজার করে একটা ব্যাগ আমার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যেত। এ তো কিছু নয়। আমার তখন রোজগার বলতে কিছুই ছিল না। লেখাপত্তর বেরোলে কিছু টাকাপয়সা আসে। তাতে কী আর কিছু হয়! একদিন হেমন্ত এসে বলল, ‘চল, গাড়িতে ওঠ। তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব।’ তা ওর কথামতো গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি এসে থামল সম্ভবত মিশন রো-র কাছে। একটা ঘরে নিয়ে এল। ঘরে ঢুকেই মনে হল একটা সুন্দর অফিস। আমি বললাম, কি রে নতুন অফিস করলি নাকি! হেমন্ত বলল, ‘তোর পছন্দ হয়েছে?’ আমি বললাম, বেশ হয়েছে। হেমন্ত বলল, ‘এটা তোর জন্যে। এখান থেকে তুই নতুন পত্রিকা বার করবি। আর এই ঘরটা তোর। সম্পাদকের জন্যে তো আলাদা একটা ঘর লাগবেই।” আমি সাকুল্যে চার-পাঁচদিন গিয়েছিলাম ওই অফিসে। ভাবনা-চিন্তা হলও অনেক। আমার দ্বারা কি বাঁধাধরা কাজ হয়! হলও না। এটা হেমন্তও জানত। তবুও আমার যাতে ভাল হয় সেইজন্য এত খরচ করেছিল। এই যে আমি অফিস গেলাম না, পত্রিকা করলাম না, এ নিয়ে একটা কথা কোনওদিন আমাকে বলেনি। হেমন্ত আমার জন্য অনেক কিছু করেছিল। ওর মতো বন্ধু পাওয়া মানে অনেক কিছু পাওয়া।”
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল কিন্তু সেইসব কথা বলতে এবং লিখতে বারণ করেছিলেন। তাই সেগুলো আর বললাম না।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সকলের মন জয় করে নিতে পারতেন অনায়াসেই। যেমন তিনি করেছিলেন বিয়ের আগে বেলাদির বাড়ির লোকজনের। তখনও বিয়ে হয়নি। তবে বেলাদির বাড়ি যাতায়াত ছিল। বেলাদিও ভাল গাইতেন। যথার্থ অর্থে তিনি সুন্দরী ছিলেন। বেলাদি আমাকে বলেছিলেন, “একবার আমার বম্বে থেকে ডাক এল। বাড়ি থেকে একলা ছাড়বে না। হেমন্তকে বললাম সমস্যার কথা। হেমন্ত বলল, আমি যাব। হেমন্ত যাবে শুনে বাড়ির সবাই বলল, কোনও আপত্তি নেই। আমি আর হেমন্ত চলে গেলাম বম্বে। গান রেকর্ড করে বাড়ি ফিরলাম।”
অনেক কিছু বলতে গিয়ে কিছু ব্যাপার না-বলা থেকে যাচ্ছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন ‘প্রিয়বান্ধবী’ (১৯৪৪) ছবিতে। ১৯৫৪-তে হিন্দি ছবি ‘নাগিন’-এ সুর দিয়ে আসমুদ্র হিমাচল মাতিয়ে দিয়েছিলেন। এমনও কথাও শোনা গিয়েছিল, নাগিন ছবিতে বিন বাজানো শুনে সিনেমা হলে সাপ নাকি ঢুকে আসত। এই ছবিতে বিন বাজিয়েছিলেন কল্যাণজি। পরবর্তী কালে কল্যাণজি-আনন্দজি হিন্দি ছবির নামী সুরকার হয়েছিলেন। আর এক নামী সুরকার রবি একসময় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সহকারী। ১৯৫৫-তে সেরা সুরকারের ফিল্ম ফেয়ার আওয়ার্ড পেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কত বড় গায়ক ছিলেন কিংবা সুরকার সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে ধৃষ্টতাও নেই। তিনি যে বাঙালির আবেগ সে কথা নতুন করে বলতে হয় না। তাঁর গান আজও বাজে প্রায় প্রতিটি বাঙালি বাড়িতে। তাই তো তাঁর গানের বিক্রি এখনও ওপর দিকে। এখান থেকেই বোঝা যায়, বাঙালি আজও কত ভালবাসে তাদের প্রিয় গায়ককে।