পার্থসারথি পাণ্ডা

মেঘ জমেছে ঈশান কোণে। মেঘের বুক চিরে থেকে থেকে ঝলসে উঠছে কপিল বিদ্যুৎ। অচিরেই ঝড় উঠবে। গুরু গুরু গুরু ডাকে ধমকের দমকে কালো মেঘ যেন বারে বারে সেটাই জানান দিচ্ছে।
আশ্রমের বারান্দায় বসে আমি আর পলাশ মহারাজ। খোলা বারান্দা থেকে ম্লান আকাশ দেখা যাচ্ছে, মেঘও। সেই কৃষ্ণকালো মেঘের দিকে বিভোর হয়ে অনিমেষ চেয়ে আছেন মহারাজ। আমি চেয়ে আছি মহারাজের দিকে। সেই অবসরে দু’জনের মধ্যিখানের মৌন সময় গুটি গুটি পায়ে পথ পেরোয়। তখন আবার মেঘ ডাকে। সেই এক ডাক, গুরু গুরু গুরু…! সেই ডাকে মহারাজ মৌনী ভাঙেন। ‘জানো তো, এই মেঘ আসলে মেঘ না, মেঘদূত। এই মহাবিশ্বে বহু যুগ ধরে সে ডেকে ডেকে মহাকালের কথা বলে যায়। এই যে ডাক দিল, বুঝতে পারলে সে কি বলল?’—মেঘের চোখ থেকে চোখ না-ফিরিয়েই আমায় প্রশ্ন করেন মহারাজ।
আমি এ-প্রশ্নের তল পাই না। মহারাজকে বলি, ‘কি জানি মহারাজ, কিছুই তো বুঝি না। একটা কথাই তো চিরকাল কানে বাজে, এখনও বাজল, সেই গুরু গুরু গুরু…!’
মহারাজ এ-বার চোখ ফেরান আমার দিকে। তাঁর চোখে এখন বহু যুগের ওপার থেকে সেঁচে আনা মুক্তোর দ্যুতি। মুখে স্মিত হাসি। বলতে শুরু করেন, ‘মেঘ গুরু গুরু গুরু বলে না। বলে, দ দ দ—দান্ত, দত্ত, দয়ধ্বম! আদি কল্পে প্রজাপতি ব্রহ্মা সৃষ্টির ভার নিয়ে মনে মনে সন্তান কামনা করেছিলেন। এতেই জন্ম নিয়েছিলেন দেবতা, মানব আর দানবেরা। এঁরা ব্রহ্মার মানসপুত্র। ব্রহ্মা এঁদের পিতা। পুত্রদের নিজের হাতে শিক্ষা দেবেন বলে ব্রহ্মা তাঁদের ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা দিয়ে নিজের কাছে রাখলেন।

একদিন শিক্ষা সম্পূর্ণ হল, পুত্রদের আত্মজ্ঞান হল। এবার দেবতারা স্বর্গে ফিরবেন, মানবেরা মর্ত্যে আর দানবেরা পাতালে। বিদায় নেবার আগে পিতার চরণে প্রণিপাত করে দেবতারা বললেন, ‘হে পিতা, যাবার সময় হল, আমাদের উপদেশ দিন।’
দেবতাদের প্রার্থনা শুনে ব্রহ্মা অত্যন্ত খুশি হলেন, উচ্চারণ করলেন, ‘দ।’ বললেন, ‘পুত্র এই আমার উপদেশ, তোমরা বুঝেছ তো?’
দেবতারা বললেন, ‘হ্যাঁ পিতা, আপনি আমাদের ‘দান্ত’ অর্থাৎ শাসন করার কথা বললেন।’
দেবতারা স্বভাবে সৌম্য, দুর্দমনীয়। তাই একমাত্র তাঁরাই জগৎ-সংসার শাসন করতে পারেন। ব্রহ্মচর্যের শিক্ষা নিতে গিয়ে দেবতা, মানব, দানব—সকলেই নিজের নিজের দোষগুণ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। তাই দেবতারা ‘দ’ শব্দের ‘দান্ত’ অর্থ করলেন দেখে ব্রহ্মা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন।
দেবতাদের পর মানবেরা ব্রহ্মাকে প্রণাম করে বললেন, ‘হে পিতা, আপনি আমাদেরও উপদেশ দিন।’
ব্রহ্মা এবারও উচ্চারণ করলেন, ‘দ।’ বললেন, ‘পুত্র এই আমার উপদেশ, তোমরা বুঝেছ তো?’
‘বুঝেছি পিতা, আপনি আমাদের ‘দত্ত’ অর্থাৎ দান করার কথা বলছেন।’
মানবেরা স্বভাবে লোভী, কৃপণ। তাই তাঁরা ‘দ’ শব্দের ‘দান’ অর্থ করলেন দেখে ব্রহ্মা খুব খুশি হলেন।
শেষে এলেন দানবেরা। পিতাকে প্রণাম করে বললেন, ‘হে পিতা, আপনি আমাদেরও কিছু উপদেশ দিন।’
ব্রহ্মা আবারও উচ্চারণ করলেন, ‘দ।’ বললেন, ‘পুত্র এই আমার উপদেশ, তোমরা বুঝেছ তো?’
‘বুঝেছি পিতা, আপনি আমাদের ‘দয়ধ্বম’ অর্থাৎ দয়া করার কথা বলছেন।’
স্বভাবে হিংস্র দানবেরা ‘দ’ শব্দের ‘দয়া’ অর্থ করলেন দেখে ব্রহ্মা বড় আহ্লাদিত হলেন। কিন্তু খানিক পরেই ব্রহ্মার মনে সংশয় এলো, ব্যাকুলতা এলো, বংশানুক্রমে পুত্রেরা তাঁর এই শেষ উপদেশ মনে রাখবে তো? ব্রহ্মার সংশয়, ব্যাকুলতা দেখে এগিয়ে এলো মেঘ। যুগে যুগে পুত্রদের কানে পিতার শেষ উপদেশ মনে করিয়ে দেবার ভার নিল। তাই আকাশজুড়ে মেঘ আজও ডেকে ওঠে, ‘দ দ দ—দান্ত, দত্ত, দয়ধ্বম।’
কথা শেষ করে মহারাজ আবার চোখ ফেরালেন মেঘের চোখে। ঠিক তখনই ডেকে উঠল মেঘ। এবার যেন স্পষ্ট শুনলাম, সে বলছে, ‘দ দ দ—দান্ত, দত্ত, দয়ধ্বম…’
Channel Hindustan Channel Hindustan is Bengal’s popular online news portal which offers the latest news