কমলেন্দু সরকার ঃ
মলিনা দেবীর জন্ম হাওড়ায়। প্রথাগত শিক্ষা সেভাবে পাননি। বেশ অল্প বয়সেই ছেদ পড়েছিল পড়াশুনোয়। মাত্র আট বছর বয়সেই রোজগারে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। ওই বয়সেই মিনার্ভা থিয়েটারে যোগ দেন শিশুশিল্পী হিসেবে। সে সময় অভিনয় বলতে নাটকের দলে নাচা। মলিনা দেবীর নাচের গুরু ছিলেন ললিত গোঁসাই। অর্থাৎ, ললিতমোহন গোস্বামী। প্রথমদিকে নাটকে সখীর দলে নাচলেও মনোমোহন থিয়েটারে এসে কম বয়সি ছেলের অভিনয় করতেন। এ প্রসঙ্গে মলিনা দেবী বলেছিলেন, ”টাকাপয়সা নিয়ে আমার গার্জেনদের সঙ্গে মিনার্ভা থিয়েটারের কর্তাদের কী গণ্ডগোল হয়েছিল কে জানে! ওঁরা আমাকে থিয়েটার থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। তারপর একদিন শুনলাম আমাকে মনোমোহন থিয়েটারে অভিনয় করতে হবে। ছেলের পার্ট। ‘জাহাঙ্গীর’ নাটকে দারা আর ‘কণ্ঠহার’-এ শ্যামল। তবে বেশিদিন পুরুষ চরিত্র করতে হল না। মলিনা দেবীর কথায়, ”ছেলে কি আর বেশিদিন সাজা গেল! গায়ে-গতরে পুরুষ্ট হয়ে গেলাম যে! তাই ছেলের রোল থেকে ছাঁটাই হয়ে গেলাম।”
এরপর অনেক লড়াই করতে হয়েছিল মলিনা দেবীকে। সিনেমার কাজ খুঁজতে লাগলেন স্টুডিয়ো পাড়ায়। অত সহজে কি আর কাজ মেলে। শিকে ছিঁড়ল। সুযোগ এল ছবিতে অভিনয়ের। প্রথম ফিল্মে অভিনয় রাধা ফিল্মস-এর নির্বাক ছবি ‘শ্রীকান্ত’-এ। ছোট্ট একটা রোল। সময়টা ১৯৩০। পরিচালক ছিলেন তারাকুমার ভাদুড়ি। জেনে রাখা ভভাল, এই ছবির নায়ক ছিলেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বাবা। পরের বছর ম্যাডান থিয়েটারের ‘দেবী চৌধুরানী’, তার পরে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রাফটের ‘চাষার মেয়ে’। এই ‘চাষার মেয়ে’ মলিনা দেবীকে করে তুলল ছবির মেয়ে। অর্থাৎ তাঁর ভাগ্য ফিরে গেল।
নিউ থিয়েটার্স-এর প্রাণপুরুষ বীরেন্দ্রনাথ সরকার বিলেত থেকে ফিরে চলচ্চিত্রে আত্মনিয়োগ করবেন বলে ঠিক করলেন। বলা ভাল, ফিল্ম নিয়ে ব্যবসা করবেন। সেই সময় বি এন সরকারকে ঘিরে ছিলেন সাহিত্যিক-পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, আর এক পরিচালক প্রফুল্ল রায়, অভিনেতা অমর মল্লিক, ক্যামেরাম্যান নীতিন বসু প্রমুখর মতো সব চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। এঁরা সকলেই মলিনা দেবীর ব্যবহার আর অভিনয়ের প্রশংসা করতেন। তাই নিউ থিয়েটার্স তৈরি হতেই ওঁরা মলিনা দেবীকে মাসমাইনের স্থায়ী শিল্পী বা অভিনেত্রী করে নিলেন।
এখানে যোগ দেওয়ার পরই মলিনা দেবীর অভিনয়জীবন-এর ধারাটাই বদলে গেল। রাইচাঁদ বড়ালের কাছে গানের তালিম নিলেন। অভিনয় শেখালেন অমর মল্লিক আর উর্দু শিখতেন আসগর হোসেন-এর কাছে।
নিউ থিয়েটার্স-এর ‘চিরকুমার সভা’য় নির্মলার চরিত্র করলেন। সকলেই তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করলেন। এ ছবির পরিচালক ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। মলিনা দেবীকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হল না। বাংলা ছবিতে কদর বাড়ল তাঁর। শুধু বাংলা কেন হিন্দি, উর্দু ছবিতেও দেখা গেল মলিনা দেবীকে। বাংলা, হিন্দি আর উর্দু মিলিয়ে ২০০-রও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন মলিনা দেবী। প্রেমাঙ্কু আতর্থী ছাড়াও ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়, হীরেন বসু, প্রমথেশ বড়ুয়া, প্রফুল্ল রায়, অমর মল্লিক, চিত্ত বসু, কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, নির্মল দে প্রমুখ অনেক নামীদামি পরিচালকের ছবিতে কাজ করেছেন মলিনা দেবী।
মলিনা দেবীর অভিনয় ছাড়াও আর একটি গুণ ছিল। তাঁর লেখার হাতটি ছিল চমৎকার। তাঁর লেখা গল্প, কবিতা, গান প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকায়। তবে সেসব লেখা বেরোতো ছদ্মনামে। পূর্ণিমা দাসীর আড়ালে ছিলেন মলিনা দেবীই। কেন ছদ্মনামে লিখতেন মলিনা দেবী নামটা তো জনপ্রিয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “নিজের নাম ব্যবহার করিনি ভয়ে। যদি আসল নাম দিলে ধরে ফেলে যে আমি অভিনয় করি, তাহলে তো আর লেখা ছাপা হবে না। জানাজানি হয়ে গেলে ভদ্দরবাড়ির কর্তাব্যক্তিরা অন্দরমহলে সে পত্রিকা ঢুকতে দেবে না। যত সৎভাবেই থাকি না কেন, আমরা অভিনেত্রীরা সব বেজাত-কুজাত। ভদ্রসমাজে আমাদের ঠাঁই ছিল না।” আমি শুনেছি, কথাগুলো বলতে বলতে চোখে জল চলে আসত তাঁর। ছোটবেলায় লেখাপড়া হয়নি একটা দু:খ ছিল মলিনা দেবীর। কিন্তু বাড়িতে লেখাপড়া করেছেন। ইংরেজিও শিখেছিলেন।
অভিনেত্রী জীবনে পুরস্কারও কিছু পাননি। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার বলতে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি আর গিরিশ সংসদের ‘নাট্যরাজ্ঞী’ উপাধি। তবে তিনি বলতেন, “দর্শকের ভালবাসাই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।” হ্যাঁ, তাই তো বাঙালি দর্শক এখনও ভোলেনি ‘সাড়েচুয়াত্তর’-এ তুলসী চক্রবর্তীর ঘরনির অভিনয়। ১৯১৬-য় জন্ম এই সহজাত অভিনেত্রী প্রয়াত হলেন ১৯৭৭-এর ১৩ অগস্ট ।
Channel Hindustan Channel Hindustan is Bengal’s popular online news portal which offers the latest news