সুমন সেনগুপ্ত
একটা গান যা পরতে পরতে ডালপালা ছড়িয়ে দেয় বাংলা গানের আঙ্গিনায়। সেই ঘটনাকে অসামান্য-অবিশ্বাস্য না বিস্ফোরণ কী ভাবে ব্যাখ্যা করব! আসলে যে কোনও যুগোর্ত্তীণ গানই স্তরে স্তরান্তরে নানা ব্যঞ্জনায় বিচ্ছুরণ ঘটাতে পারে। তেমন একটি গান ‘তোমাকে চাই’। ১৯৯২ সালে বাংলা গানের রুদ্ধ দরজার ভাঙন ঘটে ‘তোমাকে চাই’-এর হাত ধরে। ছক ভেঙে কবীর সুমন বাংলা গানকে নিয়ে এলেন সাধারণের আড্ডায়। শুরুতে ছিল না উলুধ্বনি, ছিল না উষ্ণ আলিঙ্গন। ভিকট্রি স্ট্যান্ড অনেক দূরের বস্তু। তখনকার সুমন চট্টোপাধ্যায় জানতেন বাইরের পৃথিবীর কাছে নিজেকে উপস্থাপিত করার জন্য তাঁর অস্ত্র শুধুই গান। তাই তিনি একা হাতে উল্টে দিলেন বাংলা গানের চিরাচরিত প্যাটার্ন। তিনি লিখলেন–
‘সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে/চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত প্রাণে/ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তর সুরে/কোন কবেকার অনুরোধের আসরে/তোমাকে চাই,তোমাকে চাই’॥
এত স্পষ্ট ও এত স্বচ্ছ ভাবনার প্রয়োগ এর আগে বাংলা গানে ছিল না। কথা ও ভাষায় এতটা দাপট রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে আর কেউ দেখাতে পারেনি। হ্যাঁ,সলিল চৌধুরীকে মনে রেখেই বলছি। ‘এই রোকো! পৃথিবীর গাড়িটা থামাও। আমি নেমে যাব,আমার টিকিট কাটা অনেক দূর।’ এই গানটি আজও বাংলা গানের জগতে মাইলফলক হয়ে আছে। দুর্ভাগ্য আমাদের সলিল চৌধুরী সত্যি সত্যি গাড়িটা থামিয়ে দিলেন। ছক ভেঙে আর বেরিয়ে আসলেন না।
সুমনের কথায়,আধুনিক বাংলা গানের প্রধান উপজীব্য ছিল প্রেম। সেই প্রেমের লিরিক–অভিব্যক্তিও ছিল মোটের ওপর একই ধরনের। ভাষাও হয়ে পড়েছিল বৈচিত্রহীন। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য ছিল। আসলে সে সময় যারা বাংলা গানের জগত মাতাচ্ছিলেন তাদের অনেকেই যৌথ প্রয়াসের ফসল। কেন, বলছি সে কথা। কেননা এদের কোনও বিখ্যাত গানের কথা মনে এলেই সিনেমার কোনও জনপ্রিয় জুটির কথা মনে আসে। সে ক্ষেত্রে সুমন একক ও স্বতন্ত্র। সুমনের গানে রয়েছে ভাষার দাপট ,রাজকীয় মেজাজ আর বুকভরা ভালবাসা। সুমনের গানে রয়েছে সমাজের সার্বিক অবস্থা–ব্যক্তির অবস্থান আর মানুষের বাস্তব জীবন। বাংলা গানের বিশ্লেষণে সুমন বলছেন–অজয় ভট্টাচার্য-প্রণব রায়–গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, এদের লেখা গান আধুনিক যুগের বাঙালি দীর্ঘকাল শুনেছে। কিন্তু গান ভালবাসা বাঙালি যদি নিজেকে প্রশ্ন করেন – সেগুলির মূল অবদান কি কথায়, নাকি সুরে , নাকি কন্ঠশিল্পীদের গায়কিতে? তাহলেই উত্তরটা তাঁরা নিজেরা পেয়ে যাবেন। প্রশ্নটা আসলে সুমন নিজেকে করেছিলেন। সুমনের নিজের কথায়–১৯৮৫ সালে আমাদের দল ‘নাগরিক’-এর কিছু গান রেকর্ড করার জন্য এইচ এম ভির তৎকালীন কর্তা বিমান ঘোষ মহাশয়ের কাছে যাই। তিনি সরাসরি আমাকে বলেন,তোমার গানগুলি যদি রেকর্ড করতে হয় তবে তোমাকেই গাইতে হবে। প্রথমে এই শর্ত আমি মেনে নিতে পারিনি। পরে বুঝেছিলাম তিনি ঠিকই বলেছিলেন। বাংলা গান সুমনের হাত ধরে নতুন পথে যাত্রা করল ১৯৯২ থেকে। শুরু হল বাংলা গানের দিকবদল। যোদ্ধা কবীর সুমনকে জানাই ৭০তম জন্মদিনে নিটোল ভালবাসা ও শ্রদ্ধা