Breaking News
Home / দীর্ঘ ঈ কারের মতো / পঞ্চম বাড়ি

পঞ্চম বাড়ি

সীমিতা মুখোপাধ্যায়

“হিজল ফুল দেখেছিস কোনোদিন? খুব সুন্দর। কিন্তু হিজল ফুল পুজোয় লাগে না।” —বলে ঢকঢক করে বিয়ারের বোতলটা শেষ করে দিল হিজল। “আর খাস না” বলতে গিয়েও নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। ও কি কথা শোনার মেয়ে! যা জেদ!
হিজল আমার সঙ্গে ‘মর্ডান’-এ পড়ত। স্কুলে পড়তে ওকে আমি এড়িয়েই চলতাম। কোথায় আমি আর কোথায় ও। আমার বাবা ছিল ছাপোষা মধ্যবিত্ত। ‘মর্ডান’-এ যারা পড়ে তারা প্রায় প্রত্যেকেই পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়ে, কেউই আমার মতো নয়। তার মধ্যে হিজলের বাবা বিচ্ছিরি রকমের বড়োলোক। হিজল ছোটোবেলা থেকে দারুণ সুন্দরী, প্রচন্ড স্মার্ট, পড়াশোনায় ভাল, শিক্ষকদের নয়নের মণি। ফলে, হিজলকে সব সময় ঘিয়ে থাকত একদল স্তবক, সেই চক্রব্যূহ পেরিয়ে ওর কাছে পৌঁছনোই ছিল এক দুরূহ ব্যাপার।
স্কুল শেষে হিজল গিয়ে ঢুকল প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিক্স পড়তে। আমি চলে গেলাম ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। বন্ধুবৃত্তের মধ্যে না থাকলেও হিজলের সব খবরই কানে আসত। কারণ, হিজল একটা ‘ব্যাপার’। প্রেসিডেন্সিতে পড়তে রুদ্র নামে একটি ছেলের সঙ্গে হিজলের প্রেম হল। রুদ্র পড়াশোনায় তুখোড়, দেখতেও দারুণ। দুজনকে বেশ মানাত। সবাই ভেবে নিয়েছিল— ওদের বিয়ে হবে। কিন্তু, তা হল না। কলেজ পর্ব মিটাতে না মিটতেই, ওদের প্রেমটা কেটে গেল। ফিজিক্স অনার্স পাশ করে হিজল ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়তে ভর্তি হল— বাপের অগাধ পয়সা থাকলে যা হয়। ওদিকে রুদ্র চলে গেল আর্মিতে। তারপর থেকে হিজলের নিন্দায় বন্ধুমহলে কান পাতা দায় হয়ে উঠল— হিজল নাকি আজ এ, পরশু সে করে বেড়ায়। প্রেম করাটা তার নেশায় পরিণত হয়েছে। আমি এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতাম না। কে নিজের জীবন কীভাবে উপভোগ করবে সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার।

আমি ব্যাঙ্গালোরের একটি সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি পেলাম। কলকাতা থেকে শিফ্ট হলাম ভারতবর্ষের আইটি ক্যাপিটালে। তো বছর তিনেক আগে, হঠাৎ একদিন দেখি হিজল আমার ফেসবুকের ইনবক্সে পিং করেছে— ব্যাঙ্গালোরে ‘হিজল ব্রান্ড’-এর ফ্যাশন শো আছে, আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমি এইসব গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করি। যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু, ফ্যাশন শো মিটে যেতে, আমি কেমন একটা অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করলাম— ছোটোবেলার বন্ধু বলে কথা, বড়ো মুখ করে ডাকল আর আমি গেলাম না! তাই হিজলকে পিং করে জানালাম— “সরি রে, কাজের চাপে তোর ফ্যাশন শো-টা মিস হয়ে গেল। তুই কি এখনো ব্যাঙ্গালোরে? একবার দেখা করা যায়?” হিজল মহানন্দে রাজী হয়ে গেল। কথা হল, একটি বিশেষ ক্যাফেতে আমরা দেখা করব। যথাসময়ে আমাদের দেখা হল। আড্ডা জমে উঠল। বুঝলাম, হিজল মেয়েটা বেশ ডাউন টু আর্থ, অকপট, চিন্তা-ভাবনা স্বচ্ছ, বুদ্ধিমতী তো বটেই। আফসোস হচ্ছিল, একই ক্লাসে পড়া সত্ত্বেও এই মেয়েটাকে আমি পুরো স্কুল লাইফে মিস করে গেছি! কথায় কথায় হিজল বলল— “কাল সকালের ফ্লাইটে কলকাতা ফিরে যাচ্ছি, আজ রাতটা আমার সঙ্গে আমার হোটেলে কাটাবি?” পরের দিন ছিল রবিবার, অফিস নেই। কিন্তু, হিজলের বেড়ে ওঠা আর আমার বেড়ে ওঠার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাও, দোনোমোনো করে অবশেষে রাজীই হয়ে গেলাম।
বলা বাহুল্য, হিজল উঠেছিল একটি নামকরা বিলাসবহুল হোটেলে। ওর রুমে বসে বসে আমরা বিয়ার খাচ্ছিলাম আর গল্প করছিলাম। হিজল বোতল কে বোতল বিয়ার নিঃশেষ করে যাচ্ছিল। এটা-ওটা আলোচনা হতে হতে হঠাৎ রুদ্রর প্রসঙ্গ উঠল। আমি বললাম— “রুদ্রকে ছাড়লি কেন?” হিজল বলল— “কী আর করব? ও আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেছিল।”
— “রুদ্রকে প্রথমেই বলে নিতে পারতিস যে তুই ওকে বিয়ে করবি না, তিন বছর ধরে ঘুরে-বেড়িয়ে আশা দেওয়ার কি খুব দরকার ছিল?”
— “প্রথমে বুঝিনি রে, বিষয়টা পরে এত একঘেয়ে হয়ে যাবে। আমি দুনিয়াটাকে আরও এক্সপ্লোর করতে চেয়েছিলাম। একটাই পুরুষ, একটাই প্রেম, তারপর তাকেই বিয়ে— আমি মেনে নিতে পারিনি।”
কী ঠিক, কী ভুল আমি জানি না। হিজলের বিচার করার আমি কে? কিন্তু, ওর এই সৎ স্বীকারোক্তি আমাকে বেশ অবাক করেছিল। আমি বললাম— “এখন রুদ্রর কী খবর?”
— “কেউই জানে না। আর্মি জয়েন করবে শুনেছিলাম। ফেসবুকেও নেই।”
— “র-এর এজেন্ট হয়ে যায়নি তো?”
— “হতেও পারে।”
— “তারপর আর কোথায় কোথায় এক্সপ্লোর করলি বল।”
— “ভবানীপুরে, আমার বাড়ির কাছে, একটা লাইব্রেরি আছে। মাঝখানে আমার খুব বাংলা বই পড়ার শখ হয়েছিল। লাইব্রেরিতে প্রায়ই যেতাম। লাইব্রেরিয়ান বিশ্বনাথ মাজী, পুরুলিয়ার ছেলে, প্রচুর বই পড়েছে, আমাকে অনেক ভালো ভালো বইয়ের সন্ধান দিত। তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম।”
হিজল যে বেশ অকপট আগেই বুঝেছিলাম। এখন বুঝলাম, ওর কোনো রাখ-ঢাক নেই এবং সাহসী তো বটেই। আমি বললাম— “সেটাও কাটল?”
— “হ্যাঁ।”
— “একে ছাড়লি কেন?”
— “আমি অন্যরকম কাউকে চাইছিলাম, যার সঙ্গে রুদ্রর কোনো মিল থাকবে না। বিশ্বনাথ ছিল— রোগা, গায়ের রং চাপা, ওপর ওপর রুদ্রর সঙ্গে কোনো মিলই নেই। কিন্তু, গভীর ভাবে মিশে দেখলাম— এ যেন রুদ্রই। এত মিল, এত মিল! এমনকী বিছানাতেও …”
— “আচ্ছা, বাদ দে। তার পরের জন?”
— “বৈজুনাথ, আমার মডেল, মাড়োয়ারি, দারুণ বডি। কিন্তু, মাথার ভেতরটা ফাঁকা।”
— “তুই এর সঙ্গেও প্রেম করলি?”
— “প্রেম বলতে শরীরী খেলায় মেতে উঠেছিলাম।”
— “তো সেটাকে বিদেয় করলি কেন?”
— “বিছানায় এলেই সে রুদ্র হয়ে যেত। তফাৎ, কিছুই নেই।”
— “দেখ, পুরুষ মাত্রেই কিছু মিল তো থাকবেই।”
— “হ্যাঁ, তখন মনে হয়েছিল সব পুরুষই এক রকম। তাই একটা লেসবি অ্যাফেয়ার করব ভাবছিলাম। চন্দ্রমৌলি নামে এক ট্রান্সজেন্ডারকে পেলাম।”
— “তারপর?”
— “বিছানায় নিয়ে আসার পর দেখি সে রীতিমতো সক্ষম পুরুষ। প্রবলভাবে ঠকলাম।”
— “চন্দ্রমৌলি নামটা আসলে তো পুরুষের। আমার পিসতুতো দাদার নামও চন্দ্রমৌলি। তোকে ঠকিয়েছিল বলেই কি একে ছাড়লি?”
— “সেটা একটা কারণ বটে। আমি মিথ্যে সহ্য করতে পারি না। তাছাড়া, ভেতরে ভেতরে এও যেন রুদ্র।”
— “তোর নীলকন্ঠ নামে এক কবির সঙ্গেও তুমুল প্রেম হয়েছিল, না? সে তো তোর নামে একটা কবিতার বইও লিখেছিল, মনে হয়, ফেসবুকেই দেখেছিলাম।”
— “হ্যাঁ, বইটার নাম— ‘হিজলের আঁধার-জ্যোৎস্নায়।”
— “এই কবিকে কোত্থেকে জুটিয়েছিলিস?”
— “ফেসবুক থেকে।”
— “তো তিনি এখনো আছেন না গেছেন?”
— “কলকাতায় ফিরে গিয়ে লাথিটা মারব।”
— “এও কি রুদ্রর জেরক্স কপি?”
— “এদের সবার বাইরেটাই যা আলাদা। কেন জানি না, আমার মনে হয়, এরা সবাই রুদ্রই। বারবার চেহারা বদলে ও ফিরে ফিরে আসছে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম— “দেখ একটা কথা বলি, তুই আসলে এখনো রুদ্রকেই ভালোবাসিস। ওকে ভুলতে পারিসনি। তাই তুই দুনিয়ার লোকের মধ্যে রুদ্রকে খুঁজে পাস। তারপর তোর যত আবোল-তাবোল কথা মনে হতে থাকে। নিজেকে বোঝ, অন্ধ হয়ে থাকিস না।” হিজল তীব্র প্রতিবাদ জানাল। ওর এমন একজনকে চাই যে রুদ্রর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, একদম অন্য মানুষ। আমিও আর বেশি কথা বাড়াইনি। এরা হল বড়োলোকের তথাকথিত উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ে, এদের সঙ্গে আমাদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ঠিক খাপ খায় না।

তিন বছর কেটে গেছে। মাঝে অনেক ঘটনা, করোনা, লকডাউন, কর্মী ছাঁটাই। চাকরিটা শেষ পর্যন্ত আর রাখতে পারলাম না। প্রচুর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু, হল না। চাকরি যখন নেই, তখন এত টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে ব্যাঙ্গালোরে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। সুতরাং, ব্যাক টু প্যাভেলিয়ন— কলকাতা। এত দিন ধরে ফোনে বা চ্যাটে হিজলের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা হয়েছে। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া আর হয়নি। কলকাতায় নেমে সবার আগে হিজলের কথাই মনে হল। বাবা-মার সামনে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াব— সাধ্যের অতীত করে আমাকে ‘মর্ডান’-এ পড়িয়েছে, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ দিয়েছে, ওদের কী করে বলব যে আমার চাকরি চলে গেছে! হিজলকে ফোন করতেই ও বলল— “চলে আয়। আমি তো ভবানীপুরের বাড়িতে একাই থাকি।” তল্পিতল্পা নিয়ে আমি হিজলের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। হিজলের সান্নিধ্যে সব মন খারাপ গায়েব হয়ে যেতে বেশি সময় লাগল না। নতুন করে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করতে শুরু করলাম। বাড়িতে জানে, আমি এখনো ব্যাঙ্গালোরে, আগের কোম্পানিতেই চাকরি করছি। আশা করি খুব শিগগিরই একটা চাকরি পেয়ে যাব। তারপর বাড়িতে সব কথা খুলে বলব।
একদিন আমি আর হিজল বসে বসে বিয়ার খাচ্ছি। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম— “কী রে, তোর সেই কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে খুঁজে পেলি?” হিজল বলল— “না।”
— “আর কোনো সম্পর্ক?”
— “কলকাতায় ফিরে তো সেই নীলকন্ঠ কবিকে দূর করলাম। তারপর আমি ঠিক করলাম, একটু বয়স্ক দেখে প্রেম করব। তাহলে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন স্বাদের হবে। তখন আমার জীবনে এল মৃত্যুঞ্জয়। ধানবাদিয়া, কথাবার্তায় একটু বিহারি টান, বয়স পঞ্চাশের ওপরে।”
— “এও দেখলি সেই একই রকম?”
— “হ্যাঁ, অগত্যা বিদায়। এবারে আশুতোষ চক্রবর্তী বলে একটা বুড়োকে পাকড়াও করলাম। সে যৌন ক্ষমতা হারিয়েছে। ভেবেছিলাম একটু অন্য রকম অভিজ্ঞতা হবে। হল না। যৌনতা নেই তো কী হয়েছে, সে হাবে-ভাবে চাল-চলনে পুরো রুদ্র।”
— “হুঁ, ফলে বামুন গেল ঘর। এরপর কে এল?”
— “তীর্থরাজ বলে এক কলেজ স্টুডেন্ট। সেটাই শেষ।”
— “এখন তুই তাহলে কী ভাবছিস?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হিজল বলল— “তুই বোধহয় ঠিকই বলেছিলিস— আমি আসলে রুদ্রকেই চাই। রুদ্রকে আজও ভুলতে পারিনি।”
শুনে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। বললাম— “কিছু কি করা যায় না?”
— “কী করতে চাস?”
— “রুদ্রকে যদি খুঁজে বের করা যায় …”
— “সেটা অসম্ভব।”
— “কেন অসম্ভব? তুই ওর বাড়ি চিনিস না? তিন বছর প্রেম করেছিস, তোকে বিয়েও করতে চেয়েছিল, বাড়িতে কোনোদিন নিয়ে যায়নি?”
— “নাহ।”
— “তুইও কোনোদিন জানতে চাসনি, ওর বাড়ি কোথায়?”
— “হুঁ, ও বলেছিল বেহালার মিত্রসংঘ ক্লাবের কাছে এসে “কর্নেলের বাড়ি কোনটা?” জিজ্ঞেস করলে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।”
— “ওর বাড়িতে তার মানে আর্মিতে যোগদান করার বেশ একটা রেওয়াজ আছে। কর্নেলটা কে? ওর বাবা?”
— “হ্যাঁ।”
— “বাবার নাম?”
— “কর্নেল রায়চৌধুরী। নামটা বলেছিল। কিন্তু, মনে নেই। কম দিন হল? প্রায় দশ বছর হল আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।”
— “আর কিছু বলেছিল?”
— “হ্যাঁ, বলেছিল তো … “হিজল ফুল দেখেছিস কোনোদিন? খুব সুন্দর। কিন্তু হিজল ফুল পুজোয় লাগে না …” না না, এটা রুদ্র বলেনি, নীলকন্ঠ বলেছিল … নীলকন্ঠই বলেছিল কী! আসলে ওরা সবাই এক রকমের।” হিজল মাতাল হয়ে পড়েছিল। সেদিন আর বিশেষ কথাবার্তা হল না।

পরদিন সকালে উঠে দেখি হিজল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। আমি বললাম— “কী রে, হ্যাং-ওভার কাটেনি?” হিজল বলল— “এসব আমার অভ্যেস আছে। কোনো ব্যাপার না।”
— “তবে কি মুড অফ?”
— “আমার ভালো লাগছে না রে। রুদ্রর কথা খুব মনে পড়ছে। সেই কলেজ স্ট্রিট, হাত ধরে রাস্তা হাঁটা, ট্যাক্সিতে চুমু— কী সব দিন ছিল …”
— “একবার বেহালা যাবি নাকি? বাড়ি খুঁজে না পেলে না হয় ফিরে আসব।”
— “এত দিন বাদে! গিয়ে হয়তো দেখব, রুদ্র বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করছে।”
— “ব্যাপারটা তেমন নাও তো হতে পারে। একবার ঘুরে আসলে কেমন হয়? রুদ্রকে ফিরে পাওয়ার পথ একেবারের মতো বন্ধ হয়ে গেছে কিনা —সেটাও তো জানা দরকার।”
হিজল বেহালা যেতে সম্মত হল।

বেহালা মিত্রসংঘ ক্লাবের কাছে এসে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। সামনের একটা দোকানে জিজ্ঞাসা করলাম— “আচ্ছা, কর্নেলের বাড়ি কোথায় বলতে পারেন?” ভদ্রলোক জানালেন— “পাশের ওই গলিটায় ঢুকে যান। বাঁ হাতের চারটে বাড়ি ছেড়ে বেল বাজাবেন।” আমরা যথারীতি তাই করলাম। নির্দিষ্ট বাড়িতে বেল বাজাতে এক মহিলা দরজা খুলে দিলেন, বয়স ৫৫-৫৬ হবে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম— “রুদ্র আছে?” ভদ্রমহিলা আমাদের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বেশ অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন— “আপনারা রুদ্রকে কেন খুঁজছেন?” হিজল বলল— “আমি আসলে রুদ্রর পুরোনো বন্ধু, অনেক দিন যোগাযোগ ছিল না, আজ একটা দরকারে …” ভদ্রমহিলা ততোধিক বিস্মিত হয়ে বললেন— “আপনি রুদ্রর বন্ধু!” ভদ্রমহিলার বিস্ময় দেখে আমি আর হিজল একটু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলাম। তারপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম— “রুদ্র কি বাড়িতে আছে? ও এখানেই থাকে?” মহিলা বললেন— “হ্যাঁ, এখানেই থাকে। তবে একটু বেরিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে।” হিজল বলল— “ঠিক আছে। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে ওয়েট করছি।” ভদ্রমহিলার বোধহয় এবার টনক নড়ল, বললেন— “না না, আপনারা ভেতরে এসে বসুন।” আমরা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলাম। সাহেবি কেতায় সাজানো সুন্দর ড্রইংরুম। আমি আর হিজল সোফায় গিয়ে বসলাম।
কিছুক্ষণ বাদে বছর ষাটেকের এক ভদ্রলোক সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। তাঁকে দেখামাত্রই হিজলের ভ্রু-যুগল কুঁচকে গেল। হিজল সেই বয়স্ক লোকটির উদ্দেশে বলতে লাগল— “আপনি? আপনি এখানে কী করছেন? রুদ্র আপনার কে হয়?” স্বাভাবিক ভাবেই ভদ্রলোক বেশ রেগে গেলেন। বাজখাঁই গলায় হিজলকে বললেন— “রুদ্র আমার কে হয় মানে? আমি কর্নেল মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী। এটা আমার বাড়ি।” অর্থাৎ, ইনি রুদ্রর বাবা। কিন্তু, হিজল এঁকে দেখে এমন আচরণ করছে কেন? এই ভদ্রলোক কি তবে হিজলের পূর্ব পরিচিত? কর্নেল ওই বয়স্ক ভদ্রমহিলার দিকে মুখ করে জিজ্ঞাসা করলেন— “কে এরা?” বোঝা গেল মহিলা হলেন কর্নেল-পত্নী, তিনি উত্তর দিলেন— “ওঁরা রুদ্রর খোঁজ করছিলেন। ওঁরা নাকি রুদ্রর বন্ধু।” কর্নেল বললেন— “এরা কী করে রুদ্রর বন্ধু হতে পারে! যাকে-তাকে এইভাবে বাড়িতে ঢুকতে দাও কেন?” অপমানে আমার মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠছিল। এমন সময় হিজল গর্জে উঠল— “আপনি তো আশুতোষ চক্রবর্তী, আমাকে তো এই পরিচয়ই দিয়েছিলেন। মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আর কী কী করেছেন, আপনার স্ত্রীর সামনে খুলে বলব?” ঘরের মধ্যে একরাশ নীরবতা। আমি কিছুই আর ভাবতে পারছি না। এরকমও হতে পারে! রুদ্রর বাবা এত বড়ো চিটিংবাজ! অবশ্য, হিজলের এমন হওয়াই উচিত— ঠিক করে খোঁজ-খবর না নিয়ে এই ভাবে যার-তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে!
সেই সময় সিঁড়ি দিয়ে একটি ছেলেকে নিচে নেমে আসতে দেখা গেল, জিম করা ফিগার। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ছেলেটি বলল— “মা, কী হয়েছে গো?” রুদ্রর ভাই আছে জানতাম না। ভদ্রমহিলা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে চুপ করিয়ে দিয়ে হিজল চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে শুরু করল— “এই যে বৈজুনাথ, তুমিও এখানে উপস্থিত!” ভদ্রমহিলা বললেন— “এসব কী বলছ বলো তো? ও আমার ছেলে, ওর নাম বৈজুনাথ হতে যাবে কেন?” হিজল রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জিজ্ঞাসা করল— “তবে ওর নাম কী?” ভদ্রমহিলা জানালেন, ছেলেটির নাম নীলকন্ঠ। এরা বাপ-ব্যাটাতে মিলে ষড়যন্ত্র করে তাহলে হিজলকে ঠকিয়েছে? হিজল রুদ্রকে ছেড়ে দিতে রুদ্রর কি খুব খারাপ কোনো পরিণতি হয়েছিল? এই পিতা-পুত্র কি তবে রুদ্রর হয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে? রুদ্রর ভাইয়ের আসল নাম নীলকন্ঠ। কিন্তু, নীলকন্ঠ তো সেই কবি যে হিজলকে নিয়ে ‘হিজলের আঁধার-জ্যোৎস্নায়’ বই লিখেছিল। মৃত্যুঞ্জয় নামটাও তো হিজলের মুখে শুনেছি, সেই ধানবাদের বুড়ো! হিজল বিস্ফারিত চোখে একবার কর্নেলের দিকে দেখছে আর একবার কর্নেল-পুত্রটির দিকে। আমার মনে হচ্ছে দৌড়ে পালিয়ে যাই। অবাক হওয়ার তখনো অবশ্য অনেক বাকি।
এমন সময় ভেতরের ঘর থেকে একটি অল্প বয়সী ছেলে বেরিয়ে এল, দেখে মনে হল কলেজ পড়ুয়া। তাকে দেখা মাত্রই হিজল বলতে শুরু করল— “এ তো তীর্থরাজ!” আবার কর্নেল মুখ খুললেন— “এই মেয়ে, তুমি কে বলো তো? কী উদ্দেশ্য নিয়ে এই বাড়িতে ঢুকেছ? সবার ভুলভাল নাম বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছ। ও আমার পালিত ছেলে, বিশ্বনাথ।” হিজল ছাড়বার পাত্রী নয়, সেও বলে চলল— “আপনারা প্রত্যেকেই আমার খুব চেনা। সকলেই নাম-পরিচয় ভাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।” ভাবা যায়, একই পরিবারের এত জন লোক একই মেয়ের সঙ্গে কখনো না কখনো সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে! কে যে কাকে ঠকিয়েছে, এখানে সেই ব্যাপারটাও গোলমেলে। ঠকাতে গিয়ে হিজল নিজেই ঠকে গেছে। কিন্তু, হিজল একের পর এক পুরুষের সঙ্গে যা করেছে— তাকে কি ঠকানো বলে? একটি মেয়ে বিক্ষিপ্ত, সে কী চায় নিজেই জানে না, কিছুটা পাগলও বটে— এই পুরুষগুলো কি মেয়েটার থেকে সুযোগ নেয়নি?
নানা রকম চিন্তা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে এক অদ্ভুত দেখতে মেয়ে— একমাথা সিঁদুর, নতুন কনে কনে মতো ব্যাপার-স্যাপার, অন্য একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল, পিছন পিছন একটি পুরুষ। এসেই মেয়েটি ভদ্রমহিলার উদ্দেশে বলল— “এরা কে, পিসি? এত শোরগোল কেন?” হিজল বলল— “তুমি তো চন্দ্রমৌলি!” বয়স্ক মহিলাটি বললেন— “এই একটা নাম তুমি ঠিক বলেছ। বাকি গোলাচ্ছ। তোমার কোথাও একটা খুব বড়ো ভুল হচ্ছে। চন্দ্রমৌলিকে চিনলে কী করে?” এদিকে চন্দ্রমৌলি তৎক্ষণাৎ বলে উঠল— “আমি তো এঁদের কস্মিনকালেও দেখিনি!” হিজল সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলল— “চন্দ্রমৌলির পিছনে ওটা কে? ও তো কবি নীলকন্ঠ।” ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন— “কী সব বলছ! ও তো জামাই, চন্দ্রমৌলির বর, ওর নাম আশুতোষ, ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে, একী বিড়ম্বনা!” আমি পাশ থেকে হিজলকে বললাম— “কবি নীলকন্ঠর ফেসবুক প্রোফাইলটা বের কর না।” হিজল পাগলের মতো মোবাইল হাতড়ে কিছুক্ষণ বাদে জানাল— “প্রোফাইলটা নেই, ডিলিট করে দিয়েছে।” এবার বুঝলাম হিজল কেন ওর প্রেমিকদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের এত মিল খুঁজে পেত— একই পরিবারভুক্ত হলে সেটাই তো স্বাভাবিক। আমি হিজলকে বললাম— “কবি নীলকন্ঠকে তোর চেনা-জানার মধ্যে আর কেউ কখনো দেখেনি। যে সম্পাদক ওর বই বের করেছিল তাকে হাজির করলে হয় না?” হিজল চাপা স্বরে বলল— “বুঝতে পারছিস না, ফুল ফ্যামিলি ঠক-জোচ্চোর-মিথ্যেবাদী?” আমি বললাম— “এখানে আর এক মুহূর্তও নয়।” বলে হিজলের হাত ধরে একটা টান দিতে যাচ্ছিলাম, দেখি, ঠিক সেই সময় কলিং বেল বেজে উঠল। বয়স্ক মহিলাটি বললেন— “ওই রুদ্র এল মনে হয়। রুদ্রর সঙ্গে দেখা করে তোমরা মানে মানে এবার বিদায় হও।” কিন্তু, দরজা খুলতেই দেখা গেল ড্রাইভারের পোশাক পরা একটি লোক। তাকে দেখেই হিজল বলল— “ও তো মৃত্যুঞ্জয়!” কর্নেল আবার মুখ খুললেন— “এর নাম বৈজুনাথ, আমার ড্রাইভার, ও বিহারি। তুমি কী শুরু করেছ বলো তো? উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছ! এর নাম বলছ ওর, ওর নাম বলছ তার— এসবের মানেটা কী? এবারে আমি পুলিস ডাকতে বাধ্য হব।” হিজল চিৎকার করে বলল— “বেশ, ডাকুন পুলিস। আপনারা প্রত্যেকে ফ্রড। গোটা পরিবার মিলে ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসিয়েছেন।” আমি হিজলকে ফিসফিস করে বললাম— “তোর কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?” হিজল বলল— “না, একেবারেই নয়।” বিষয়টা যেন অনেকটা সেই ‘থানা থেকে আসছি’-র মতো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, রহস্যটা আরও জোরালো। অবশেষে, আমি অনেক ভেবে কর্নেল-পত্নীকে বললাম— “ঠিক আছে আন্টি, আমরা রুদ্র এসে পড়া অবধি অপেক্ষা করে যাই। রুদ্রর সঙ্গে দেখা করেই চলে যাব।” আমার কথাতে কর্নেল আর তাঁর স্ত্রী ছাড়া সকলেই যে-যার মতো নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
আমাদের আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। অনতিবিলম্বকাল পরেই পুনরায় বেল বাজল। হিজলের বুকের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছি। ওর সঙ্গে সঙ্গে ওই ধুকপুক আমার বুকের মধ্যেও অনুরণিত হচ্ছে। এবারে আবার কী! ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন। বাজারের ব্যাগ হাতে একজনের প্রবেশ। দেখে মনে হল, বাড়ির চাকরই হবে। ভদ্রমহিলা আমাদের উদ্দেশে বললেন— “এই যে তোমাদের বন্ধু, রুদ্র এসে গেছে। রুদ্র, তুমি এই মেমসাহেবদের চেন নাকি?” আমি ফেসবুকে রুদ্রর সঙ্গে হিজলের একটা ছবি দেখছিলাম, বহু বছর আগে। তাও, হলফ করে বলতে পারি এ-ছেলে, সে-ছেলে নয়। কিছুতেই হতে পারে না। আমি হিজলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, ও কী বলে শোনার জন্য অপেক্ষা করছি, হিজল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল— “ওর নাম বিশ্বনাথ।” আমি তাড়াতাড়ি করে হিজলের হাত ধরে টানতে টানতে ওদের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। বাইরে বেরিয়ে বললাম— “এগুলো কী হিজল? তোর মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে।” হিজল আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে দেখি নিজের মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে— “আশুতোষটা হল মৃত্যুঞ্জয়, বৈজুনাথ হল নীলকন্ঠ, তীর্থরাজ হল বিশ্বনাথ … ” হঠাৎ, আমার মাথায় একটা অদ্ভুত চিন্তা খেলে গেল। হিজলকে তাড়াতাড়ি বললাম— “একটা জিনিস ভেবে দেখেছিস কি, চন্দ্রমৌলি থেকে শুরু করে বৈজুনাথ, তীর্থরাজ, আশুতোষ সব শিবের নাম?” হিজল একটু থামল। তারপর বলল— “সব শিবের নাম? তাই তো! আমি তোকে বলতাম না, একজনই যেন চেহারা পাল্টে পাল্টে আমার কাছে আসে।” পরিবেশটা একটু হাল্কা করার জন্য আমি হিজলকে বললাম— “তোর নষ্টামি দেখে, সহ্য করতে না পেরে কৈলাশ থেকে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব নেমে আসেন তোকে শাস্তি দিতে।” হিজল আমার কথায় তেমন পাত্তা না দিয়ে বলল— “ওসব বাদ দে। কে বাদ গেল বল।”
— “তার মানে?”
— “কেউ একটা বাদ গেছে। যে বাদ গেছে সেই হল রুদ্র, মানে যে রুদ্রকে আমি চিনতাম।”
আমিও মেলাতে শুরু করলাম— “বিশ্বনাথ হল রুদ্র, মৃত্যুঞ্জয় হল বৈজুনাথ, নীলকন্ঠ হল আশুতোষ …”
হঠাৎ হিজল চিৎকার করে উঠল— “পেয়েছি পেয়েছি! রুদ্রর আসল নাম হল তীর্থরাজ। না, মানে নকল নাম। না মানে …জানি না কোনটা আসল আর কোনটা নকল। তবে, তীর্থরাজটাই শুধু বাদ গেছে। তীর্থরাজকে আমরা দেখিনি।” আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগল, হিজলকে বললাম— “দেখ কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, ওই বিশ্বনাথ লাইব্রেরিয়ান, তুই তো বলেছিলিস সে প্রচুর বই পড়েছে। সেই বিশ্বনাথ কী করে এদের বাড়িতে রুদ্র চাকর হয়ে যেতে পারে? শিক্ষিত লোকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে তো একটা ব্যাপার আছে। হয় তোর ভুল হচ্ছে। নয়তো এরা সর্বৈব মিথ্যে বলছে এবং প্রত্যেকেই পাক্কা অভিনেতা।” হিজল শান্ত গলায় বলল— “রুদ্রর খোঁজ পেতে গেলে ওই বাড়িতে আরেকবার যেতে হবে।” শুনে আমি আঁতকে উঠলাম। বললাম— “হিজল, এই ভুল করিস না। ওরা, মনে হয়, সবাই মিলে তোর কিছু একটা ক্ষতি করতে চাইছে।” হিজল তো কথা শোনার মেয়ে নয়। আমাকে বলল— “তোকে যেতে হবে না। আমি একবার ঘুরে আসছি।” এ-কথা বলে হিজল আবার ওদের বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল। অগত্যা আমিও হিজলের পিছু নিলাম। হিজল ওদের বাড়ির বেল বাজাল। বয়স্ক মহিলাটি দরজা খুললেন। আমাদের দেখেই বিরক্ত হয়ে বলতে শুরু করলেন— “তোমরা আবার? কেন এইভাবে উৎপাত করছ? বললে তো রুদ্রর সঙ্গে দেখা করে চলে যাবে। আবার কী চাই?” হিজল বলল— “কিছু চাই না। শুধু এটুকু বলুন তীর্থরাজ কে।” শোনামাত্র মহিলাটি বলে উঠলেন— “দেখবে? দেখবে? তীর্থরাজ কে দেখবে?” বলে হিজলের হাত ধরে হিড়হিড় করে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে গেলেন। হিজলের জন্য না জানি কী অপেক্ষা করে আছে! এভাবে হিজলকে একা ওদের হাতে ছেড়ে দেওয়াও ঠিক হচ্ছে না। সাত-পাঁচ না ভেবে, আমিও পেছন পেছন ছুটলাম। ড্রইংরুম পেরিয়ে ভদ্রমহিলা হিজলকে ভেতরের একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে গেলেন। আমিও সেই ঘরে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি, দেয়াল জুড়ে আর্মির পোশাক পরা অতি সুদর্শন এক যুবকের ছবি, গলায় ফুলের মালা, ফুলগুলো শুকিয়ে গেছে। ফেসবুকের সেই ছবিতে হিজলের সঙ্গে সম্ভবত একেই দেখেছিলাম। মহিলা বলে চললেন— “মেজর তীর্থরাজ রায়চৌধুরী। আমার দেওর। কার্গিল যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।” সকলেই বাকরুদ্ধ।
আমি আর হিজল ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। হিজলের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। কিছু বলা-কওয়ার অপেক্ষা রাখে না, তাও জিজ্ঞাসা করলাম— “হ্যাঁ রে, এ-ই কি সে?” হিজল ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। পরক্ষণেই চোখ মুছে হিজল বলল— “এখানেও একটা খটকা। কার্গিল যুদ্ধ কত সালে হয়েছিল?” আমার সাল-টাল কিছুই মনে পড়ল না। হিজল নিজেই গুগল করে বের করল— ১৯৯৯ সালে। শুনে আমি বললাম— “মানে! তখন তো আমরা খুব ছোটো!”
— “হ্যাঁ, ক্লাস থ্রি।”
— “কিন্তু, রুদ্র মানে ওই তীর্থরাজ তো তোর সঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে পড়ত। তোর ক্লাস থ্রি-তে পড়াকালীন যে মারা গেছে, সে তোর সঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে পড়বে কী করে? ভুল হচ্ছে।”
— “ওটা রুদ্ররই ছবি ছিল।”
— “তোর প্রেসিডেন্সির কোনো বন্ধুর সঙ্গে এখন যোগাযোগ নেই, যে রুদ্রকেও চিনত?”
— “আছে তো। আমাদের গ্রুপ ফোটোও আছে।”
— “ওই ছবিগুলো এনে যদি এদের দেখানো যায়?”
— “কোনো লাভ নেই। সবই মায়া। এরা যা বলছে তা হয়তো সত্যি। আবার আমার দেখাটাও সত্যি। আসলে দুটো আলাদা জগত। মিত্রসংঘ ক্লাবের পাশের গলির পঞ্চম বাড়ি আর তার বাইরের পৃথিবী— দুটোই আছে, কিন্তু, একটু অন্য রকম ভাবে আছে।”
দিন-দুপুরে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তাহলে কি এতক্ষণ আমরা একটা হানাবাড়িতে কাটিয়ে এলাম? এলাকার লোকেরাও কি জানেন না, ওই বাড়িতে যারা থাকে তারা সকলেই অশরীরী। নাকি পুরো ব্যাপারটাই ব্যাখ্যার অতীত! হিজল নিজে সত্যি তো? আমি সত্যি? এমনও তো হতে পারে ওই বাড়িটাই আসলে সত্যি আর বাড়ির বাইরের জগতটা মিথ্যে। আমার সব কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগল। আমি আমতা আমতা করে হিজলকে বললাম— “তাহলে কি তোর রুদ্রকে আমরা খুঁজে পাব না কোনোদিন?” উত্তর এল— “মহাকাল জানেন।”

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *