কমলেন্দু সরকার :
১৯৪৭। মুক্তি পেল পরিচালক দেবকীকুমার বসুর ‘চন্দ্রশেখর’। এই ছবিটি যেদিন রিলিজ করে সেদিন টিকিট কাউন্টারে ভিড় সামলাতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। বাংলা ছবি নিয়ে এমন উন্মাদনা আগেও দেখা যায়নি, পরেও নয়। অশোককুমার-কানন দেবীর জনপ্রিয়তা এমনই ছিল। ওঁদের কথা এখন নয়। এই ছবিতে আর এক ছিলেন তিনি নীতীশ মুখোপাধ্যায়। মীরকাশিম চরিত্রের অভিনেতা। নীতীশের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অভিনয় আজও মনে রেখেছেন ওই ছবির প্রবীণ দর্শকেরা।
নীতীশ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১৭-য়। আদিনিবাস নদিয়ার শান্তিপুরে। সম্ভ্রান্ত পরিবার। বাবা ভূজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৯৩৩-এ নীতীশ ম্যাট্রিক পাশ করেন সাউথ সুবার্বান স্কুল থেকে। তারপর আশুতোষ কলেজ। সেখান আইএ করেন। এরপরই পড়াশুনোয় ইতি। কিছুদিন প্রতিরক্ষায় চাকরি করেন। চাকরিতে মন টেকেনি। তাঁকে প্রবলভাবে টানত গান। তার কারণ, নীতীশ গানের পাঠ নিয়েছিলেন দুই প্রবাদপ্রতিম গায়কের কাছে। একজন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, অন্যজন তারাপদ চক্রবর্তী। অভিনয়ের শিক্ষাগুরু শিশিরকুমার ভাদুড়ি। নীতীশ নিয়মিত অভিনয় করতেন শিশির ভাদুড়ির শ্রীরঙ্গম নাট্যমঞ্চে। এতরকম খাবার থাকতেও তাঁর প্রিয় ছিল কচুরি। শুনেছি, যেদিন শ্রীরঙ্গমে অভিনয় থাকত সেদিন হল-এ ঢোকার আগে গোটা ১২ কচুরি খেতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি মজা করে বলেছিলেন, ”বড়বাবুর (শিশিরকুমার ভাদুড়ি) শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে পার ডে ছ’আনা করে পেমেন্ট পেতাম যে। ভাল গান গাইলেও, তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল অভিনয়।
প্রথম অভিনয় করেন কালী ফিল্মস-এর ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৯৩৯) ছবিতে। পরিচালক নরেশ মিত্র। এর পরে একাধিক ছবি করলেও তেমন সুবিধে করতে পারছিলেন না সিনেমা জগতে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। একটা সময় তিনি ঠিকই করেছিলেন, অনেক হয়েছে আর নয়। আবার এত সহজে পরাজয় স্বীকার করতেও মন সায় দিচ্ছিল না। ১৯৪৭-এ ‘মুক্তির বন্ধন’ নীতীশকে আবার সিনেমা জগতে ফিরিয়ে আনল। ভাগ্যদেবী সঙ্গী হলেন ‘চন্দ্রশেখর’ থেকে। তবে ভাগ্য বিশ্বাস করতেন না তিনি। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ভাগ্য কী আছে সেটা জানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি কর্মে বিশ্বাস করি। পুরুষাকারে বিশ্বাস করি।”
‘চন্দ্রশেখর’-এর পর জনপ্রিয়তার শিখরে বিচরণ করতে লাগলেন নীতীশ মুখোপাধ্যায়। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাননি। কতসব চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে—- ‘সাধারণ মেয়ে (১৯৪০)-তে অজিত, ‘মহাকাল’ (১৯৪৮)-এ অনিরুদ্ধ, ‘কবি’ (১৯৪৯)-তে রাজন, ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৯৫২)-য় কাপালিক, ‘সবার উপরে’ (১৯৫৫)-তে রায়বাহাদুর, ‘রাইকমল’ (১৯৫৫)-এ রসিক দাস, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ (১৯৫৬)-এ ছোটবাবু ইত্যাদি চরিত্র আজও প্রবীণ দর্শকেরা মনে রেখেছেন।
নীতীশ মুখোপাধ্যায় কাজ করেছেন—– নরেশ মিত্র, নীরেন লাহিড়ি, দেবকী বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, চিত্ত বসু, অগ্রদূত, মধু বসু প্রমুখ পরিচালকের ছবিতে। নীতীশ মুখোপাধ্যায় অভিনীত শেষ ছবি ‘রাজা রামমোহন’ (১৯৬৫)। এই বছরই তাঁর আর একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল ‘রূপ সনাতন’।
শুধু সিনেমায় নয়, মঞ্চেও নীতীশ ছিলেন দাপুটে অভিনেতা। শ্রীরঙ্গম ছাড়াও অভিনয় করেছেন অন্যান্য মঞ্চেও। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘সঞ্জীবন ফার্মেসী’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘আরোগ্য নিকেতন’ নাটকের প্রধান চরিত্র জীবনমশাই-এর ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন তিনি।
নীতীশ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠাস্বর ছিল অপূর্ব! ছিল অসাধারণ বাচনভঙ্গি। হাড়-হিম করা চাউনি ছিল তাঁর অভিনয়-সম্পদ। নীতীশ মুখোপাধ্যায়ককে বাদ দিয়ে বাংলা সিনেমা এবং নাটকের ইতিহাস লেখা যায় না। উচিতও নয়। তাঁর পরদা উপস্থিতি অনেক নায়ককেও ম্লান করে দিত। শুনেছি উত্তমকুমারও নাকি ভয় করতেন নীতীশ মুখোপাধ্যায়কে। এহেন এক অভিনেতার শতবর্ষ চলে যাচ্ছে চুপিচুপি।
(চ্যানেল হিন্দুস্তান-ই সম্ভবত প্রথম শ্রদ্ধা জানাচ্ছে তাঁর জন্ম শতবর্ষে)
![](https://channelhindustan.com/wp-content/uploads/2017/05/43333.jpg)