ইমাকুলেট কনসেপশন
সুরজিৎ চক্রবর্তী :
বাংলা ভাষায় এমন এক একটা শব্দ হয় যার উচ্চারণ তোমায় কথায় কথায় রোমান্টিক করে দেবে, আঁজলা তেমনি একটি শব্দ l
কলকাতা শহরে চাপকল তেমন একটা দেখি না, হয়তো অনেক জায়গায় আছে কিন্তু আমার চোখে পড়ে না, শহরতলীতে কিন্তু আজও বহু জায়গায় সহজেই চাপকল নজরে পড়ে, যেমন ঠান্ডা তেমনি মিষ্টি স্বাদু তার জল।
রাজ্যধরপুরে একটা ফোর-হুইলার শোরুমে অফিসিয়াল কাজেই এসেছিলাম। আমি একটা চারচাকা কোম্পানির সেলস ডিভিশনের এরিয়া ম্যানেজার।
চাপকলের কথায় আসি, বড় রাস্তার পাশে একটা মাঝারি রাস্তার মুখেই এই চাপকলটা, আগের বার দেখেই ভেবে ছিলাম একদিন এই চাপকলের জল খাব, এমনিতে এটা বিশেষ কোনো ব্যাপার নয়, কিন্তু আমি বহুদিন কোনো চাপকলের জল খাইনি, আজ হঠাৎ ইচ্ছে হল। চাপকল থেকে যারা পাত্র ছাড়া হাতে করে জল খেয়েছে তারা জানে প্রথমে ডান হাত দিয়ে চাপকলের মুখটা আটকে, বামহাত দিয়ে কলটা পাম্প করে চাপকলের মেইন সিলিন্ডারটা ভরে ফেলতে হয়। তারপর ডানহাতের আর কলের বর্ডার লাইনে মুখ লাগিয়ে আঙ্গুলটাকে একটু হালকা করে জল খেতে হয়। বাকি পড়তে থাকা জলেই আঁজলা ভরে চোখেমুখে জল ছিটিয়ে নিলাম, আঃ কী শান্তি! জামার সামনের বুকটা ভিজে উঠল। মনে হচ্ছে কোলে ওঠা কোনো ছোট বাচ্ছা হিসি করেছে, মুখ তুলতেই দেখি পারমিতা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মুখে কৌতুক ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল― “আরে পলাশদা তুমি এখানে কী করছ?” বিশ্বাস করুন আমি বিন্দুমাত্র জানতাম না পারমিতা এখানে কী করে এল! যদি জানতাম তবে কি এভাবে এখানে দাড়িয়ে বুক ভিজিয়ে জল খেতাম? পারমিতার প্রতি আমার একটু ইয়ে আছে। কিন্তু, পারমিতা চাঁদ আর আমি বামন। শীতের দুপুরের মতো গায়ের রং ওর, কমলকলির মতো হাত আর শাপলা ডাঁটির মতো আঙ্গুল। আমি ওর যতই ঘনিষ্ট হই, আমাকে জাস্ট ওর পাশে মানায় না। পারমিতা আবার জিজ্ঞেস করল― “এখানে কী করছ?” আমি বললাম― “অফিসের কাজে এসেছিলাম, এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।”
―”তবে চলো, আমার বাড়ি কাছেই।” পারমিতা ডাকবে, আমি যাব না, এত বড় বুকের পাটা আমার নেইl
পারমিতার সঙ্গে কিছুদিন আগে আমার এক পিসতুতো দাদার বিয়েতে আলাপ হয়েছিল, বৌদির কীরকম দূর-সম্পর্কের খুড়তুতো বোন হয়। বিয়ের ক’দিনে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। ভালো গাইতে পারে, নাচতে পারে, চার্টার্ড পড়ছে। চোখ আর ভ্রু ভ্রমর কালো নয়, তবে দেখলেই মনে হয় যেন জলে ভেজা। এরকম চোখকেই বোধহয় লিকুইড আইস বলা হয়। খুব হুল্লোড়বাজ, সবার সঙ্গে সহজেই মিশতে পারে, আমি পারি না। ক্রেতাদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারলেও বাকিদের সঙ্গে পারি না, কিন্তু পারমিতা পারে। সে আমার আমার মতো স্থবির পাথরকেও পার্বত্য প্রবাহে সহজেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পারমিতার চোখের মনিটা কুয়াশা কটা, ওর চোখের দিকে তাকালেই আমার বহুদিন আগে দেখা গাড়োয়াল কুমায়ুনের একটা পাহাড়ি সরোবরের কথা মনে পড়ে। আমি মাঝে মাঝে সেই সরোবরটার পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম। পারমিতার পাতলা গড়ন, তবে গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা প্রায় আমার মাথায় মাথায়। রূপোর পায়েস বাটির মতো স্তন তার, অগোছালো কাপড়ে ওর চন্দ্রকলা নাভি দেখেছি। কিন্তু, বিশ্বাস করুন আমার একবারও পাপ করবার ইচ্ছে হয়নি, আমি অনন্ত মুগ্ধলোকের দিকে তেষ্টায় তাকিয়েছিলাম, পাহাড়ি ঝর্ণার মতো কেশদাম ওর, সবসময় ছটফট করছে। বিয়েবাড়িতে কেউ বরের শ্যালিকাদের আমিষ জোকস শোনালে তা ও খুব কৌশলে এড়িয়ে গেছে― এমনি রুচিসম্মত রসবোধ তার। অনেকেই বিয়ে বাড়িতে, গাইতে পারে, নাচতে পারে, জোকস বলে আসর জমাতে পারে। এরকম কোনো গুণ আমার নেই। দু-একবার বাথরুমে গান গাইবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার নিজেরই শুনতে এত খারাপ লেগেছে, অন্যদের কী শোনাব! আমি কেবল আমার একটা স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলাম, পারমিতা পরদিনই আমায় ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল।
পারমিতার বাড়ি পৌঁছে জানলাম, ওর বাবা মা দুজনেই চাকরি করে। কাজেই অসময়ে বাড়িতে রান্নার মাসি বাদে কেউ নেই। তিনিও এই অসময়ে একতলায় ঘুমোচ্ছেন। আমরা উঠে গেলাম দোতালার ডাইনিং-এ, সে এই দুপুরবেলায় একজনের কাছ থেকে টিউশন নিয়ে ফিরছিল।
প্ল্যান ছিল, শোরুম থেকে বেরিয়ে একটা ভাতের হোটেল খুঁজে খেয়ে নেব। সেলসের প্রফেশনে আসবার পর থেকেই খাওয়া আর শোয়া এই নিয়ে কোনো বাদবিচার আমার নেই,
ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে। তাছাড়া বাড়ির বাইরে খেলে আমি একা খেতেই পছন্দ করি, তার একটা বিশেষ ব্যক্তিগত কারণ আছে। শুনলে হয়তো হাসবেন বা ন্যাকামো ভাববেন।
মা আর দিদি আমার সব কাজ করে দিয়ে দিয়ে আমার এমন একটা বাজে অভ্যেস তৈরি করেছে
যে ভাত মাখা আর মাছ বাছা দুটোই আমি ঠিক মতো পারি না, তাই হোটেলে একাই খাই আর দুহাত দিয়ে কাঁটা বাছি। পারমিতাই কথা তুলল― “বলো, পলাশদা কী খাবে।” আমি বললাম― “না না ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমি এই তো খেলাম।” বলেই বুঝলাম মিথ্যে কথাটা ঠিকঠাক গুছিয়ে বলা হয়নি। এক এক সময় এমনি হয়, আয়না ছাড়াও নিজের মুখের এক্সপ্রেশনটা মানুষ নিজেই পরিষ্কার দেখতে পায়। আমার সব আপত্তি হওয়ায় উড়িয়ে দুজনের জন্য ভাত মাছ তরিতরকারি বেড়ে এনে পারমিতা ডাইনিং টেবিলটায় রাখল। পারমিতার সেদিনের জোরটুকু আমার ভালো লেগেছিল, কেউ সবকিছু ফেলে আমার মতো সামান্যের জন্য কিছু করছে এতে একটা তৃপ্তি, একটা পাওয়ার অধিকার বোধ আছে। সে এবার কপট হুকুমে বলল― “নাও এবার খেয়ে নাও।” অত্যন্ত আন্তরিক সে আহ্বান আমার পক্ষে উপেক্ষা করা সহজ ছিল না। আমার ভাত মাখার ধরণ দেখে ও সহজেই আমার দুর্বলতা ধরে ফেলল। এবার আমি কনফেস করলাম, আমি মাছ বাছতেও পারি না, তারপর নিজেই নিজেকে অপদার্থতার জন্য গালাগাল দিলাম। পারমিতা এবার হাসতে হাসতে বলল― “ফেসবুকে সবাইকে জানিয়ে দেব, তুমি মাছ বেছে খেতে পার না।” পারমিতা আমার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে এই যে আমার থালায় মাছে বেছে দিচ্ছে, এতে যেন কেমন একটা ঘনিষ্ট ছবি আমাদের চারপাশে তৈরি হয়েছে। আমি একটু একটু করে ভাত খাচ্ছিলাম আর মনে মনে বলছিলাম, এই মুহূর্তটা যেন কখনো শেষ না হয়ে যায়, এই যে তুমি আমার থালায় হাত ঠেকিয়ে জানান দিলে যে আমি অসহায় হলেই তুমি ছুটে আসবে এরকম একটা ছবি আমার মনে বহুদিন রয়ে যাবে l
আমি কাতর পাখির মতো একতরফা ভালোবাসায় পারমিতাকে দেখেই চলেছি, পারমিতা হঠাৎই বলে উঠল― “এই পলাশদা এরকম হ্যাংলার মতো হাঁ করে মেয়েদের দেখতে নেই, তাতে পুরুষত্ব খাটো হয়।” আমার খুব মানে লাগল, আমি তড়িঘড়ি খেয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লাম। বললাম― “প্রচুর কাজ পড়ে রয়েছে, অনেকগুলো জায়গায় যাওয়ার আছে।”
প্রখর রোদে আসবার সময় আকাশে যে একছোপ কালি দেখে এসেছিলাম, সেটাই এখন কালাপাহাড় হয়ে পৃথিবীর সমস্ত আলো শুষে নিয়েছে। আকাশের এখন-তখন কাঁদবার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। ব্যাগপত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলাম, পারমিতা আমার সঙ্গেই ছুটে নামল।
―”একটু দাঁড়িয়ে যাও না পলাশদা, এখনই আকাশ ভিজে উঠবে। তুমি রাগ করেছ, আমি কি তোমায় আঘাত দিলাম?”
উঠোন পার হওয়ার আগেই হাপুসনয়নের বৃষ্টি নামল। পারমিতা ছুটে এসে আমার জামার পেছনটা খামচে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তীব্র বর্ষায় দুজনের শরীর ভিজে যাচ্ছে তখন। পারমিতা আমার পিঠে লেগে রইল, আকাশ-পৃথিবী ভেঙে এদিকে ওদিকে বাজ পড়তে লাগল। শোঁ শোঁ শব্দে ঝোড়ো হওয়া আর কানে তালা লাগানো বাজের শব্দ। এই বুঝি গোটা পৃথিবীটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাবে, আর ঠিক তখনি বাড়ির গেটের বাইরে একটা বাজ পড়ল। সে কান ফাটানো আওয়াজে আর আলোতে আমি আর পারমিতা দুজনেই অচৈতন্য হয়ে ওদের উঠোনে পড়ে রইলাম, জ্ঞান ফেরার পর দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভিজে জামাকাপড়ে বাড়ি ফিরে চললাম। আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। আমি জানি, আমি পারমিতার কেউ না, কেউ না। ওর জন্য কোনো টল-ডার্ক-হ্যান্ডসাম আগেই ঠিক করা আছে। তবু এই যে একটা দিন পারমিতা আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এটাও মিথ্যে নয় l
তারপর আটবছর হয়ে গেছে আমার কোম্পানি বদল হয়েছে আর এখন ওদিকে যাওয়া হয় না। আসলে আমি যেমন যাইনি, পারমিতাও কোনোদিন আমায় ডাক পাঠায়নি। হয়তো আমার মতো সাধারণের জন্য তার সেদিনের তাৎক্ষণিক
উচ্ছ্বাস সে পরবর্তী বিবাহিত জীবনে ভুলে গেছে l
খালি আমি সেই দিনটা ধরে এই আট বছর একই রকম রয়ে গেছি। একতরফা ভালোবাসায় নাক গলানোর কেউ নেই, অন্যের অধিকার বোধ নেই, তাই নিয়েই ডুবে আছি l
আজ একটা অন্য কাজে আঁরিয়াদহ দিয়ে ফেরি পার হচ্ছি, দেখলাম নৌকোয় একজন মেয়ে সঙ্গে একটা বছর সাত-আটকের ছেলে সঙ্গে করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আমায় বার বার লক্ষ্য করছে। খুব ভালো করে দেখতেই বুঝতে পারলাম মেয়েটা আর কেউ নয়, পারমিতা আর সঙ্গের বাচ্চা ছেলেটা বোধহয় ওর ছেলে। যাক, পারমিতা তাহলে বিয়ে-থা করে সংসারী হয়েছে, আমিই কেবল সেদিন কথাগুলো ধরে বসে আছি। নৌকো থেকে নেমে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম― “কেমন আছ? তোমার বুঝি উত্তরপাড়ায় বিয়ে হয়েছে? খুব ভালো। এই বুঝি তোমার ছেলে?” বাচ্চাটাকে আদর করে বললাম― “তোমার নাম কী?” সে বলল― “প্রিয়ম।”
―”আমি তোমার একজন মামা হই, পলাশমামা।”
পারমিতা এবার রাগ দেখিয়ে বলল― “তুমি ওকে একদম আজেবাজে কথা শেখাবে না।”
― “প্রিয়ম, উনি তোমার বাবা হন, মামা নয়।” বলেই পারমিতা গেট ঠেলে হনহন করে বেরিয়ে গেল। টিকিট কালেক্টরকে টিকিটটা ছুড়ে দিয়েই আমি পারমিতার পিছন পিছন ছুটতে লাগলাম। মনে মনে বললাম― “যা বাবা! একি ইমাকুলেট কনসেপশন! এরকম সত্যি হয় নাকি,বিজ্ঞান যে তবে গোল্লায় যাবে!”
সুরজিৎ চক্রবর্তী:
১৯৭৯ সালের ৮ই মে, হুগলী জেলার শহরতলী রিষড়ায় জন্ম l বাণিজ্যে স্নাতক হওয়ার পর আইটি নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা এবং চাকরি, পেশা পরিবর্তন করে গত ১২ বছর ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে পেশায় আছেন। মূলত কিছু লিটল ম্যাগাজিনেই লিখেছেন― কবিতা, গল্প, প্ৰবন্ধ। লেখার বিষয়ে মনে হয়, এসব কিছু তিনি সব সময় ইচ্ছে করে লিখেননি, আসলে লেখাগুলোই তাঁকে দিয়ে জোর করে লিখিয়ে নিয়েছে। তাঁর কবিতা লেখার প্রিয় সময় নিশুতি রাত।